দেশের ইয়াবা সিন্ডিকেট ৩৩ হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছে দেশী ও আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবার। ইয়াবার আন্তর্জাতিক হুন্ডি ব্যবসার প্রধান অফিস দুবাইয়ে। ইউএইর দুবাই থেকে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার পর্যন্ত ইয়াবা সিন্ডিকেটের বিশাল রাজত্ব নিয়ন্ত্রিত হয়। দুবাই হয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে লেনদেন করে ‘ইয়াবা ডন’। কক্সবাজার, টেকনাফে আটক ইয়াবা কারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তবে ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্য ও হুন্ডি ব্যবসায়ীর অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত দেড় বছরে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে প্রায় একশ’ ইয়াবা কারবারি। আত্মসমর্পণ করেছে তালিকাভুক্ত ১০২ জন। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হয়। কিন্তু ইয়াবা পাচার ও কারবার কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। যদিও ইয়াবার কারবার অনেক কমেছে। দেশের আনাচে-কানাচে ইয়াবা পাওয়া সহজলভ্য নয়। প্রায়ই চালান ধরা পড়লেও ইয়বা বেচা-কেনায়, সাবধানতায় দুষ্প্রাপ্য।
পুলিশ সদর দফতরের মতে, শীর্ষ ইয়াবা কারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ী হাজী সাইফুল ইসলাম গত মাসে গ্রেফতারের পর ইয়াবা কারবারি ও ইয়াবা ডনদের তালিকা দিয়েছে। এই শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেফতারের আগে দুবাইয়ে ছিল। ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ার আগে হাজী সাইফুল কক্সবাজার টেকনাফের ইয়াবা সিন্ডিকেট, হুন্ডি, ইয়াবা ডনদের রাজত্বের বর্ণনা দিয়েছে পুলিশকে।
পুলিশ জানায়, ইয়াবা কারবারি ও বাহকরা মাদক ব্যবসার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও নেপথ্যে যারা দেশে ইয়াবা আনার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে, তারা হুন্ডি ব্যবসায়ী। কীভাবে দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে দুবাই, সিঙ্গাপুর ও ভারতে ইয়াবা কেনার টাকা পাচার হচ্ছে, তা বের করছে পুলিশ। কক্সবাজার ও টেকনাফে এ রকম ৩৩ হুন্ডি ব্যবসায়ীর সন্ধান মিলিছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন দুবাইয়ে বসে হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। পুলিশের তদন্তে মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে বাংলাদেশে ইয়াবার চালান আসছে। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বেশিরভাগ ইয়াবা ঢুকছে। ইয়াবা কারবারিরা বাহকের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইউনিট ইয়াবার কারবারি, হুন্ডি ব্যবসায়ী, ডনদের নতুন তালিকা তৈরি করছে। এতে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের নামও উঠে আসছে। এরা দুবাই, সিঙ্গাপুর ও ভারতে ইয়াবার টাকা পাচার করছে।
কক্সবাজার ও টেকনাফের ৩৩ হুন্ডি ব্যবসায়ীর তালিকায় অন্যতম হচ্ছে টেকনাফের মধ্যজালিয়াপাড়ার জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর, নামার বাজারের বদি আলম, সাতকানিয়ার উসমান, গোদারবিলের টিক্কা কাদের, মধ্যজালিয়াপাড়ার ইসহাক, ইয়াসিন, ওসমান, তাহের ও আবুল আলী (সাংবাদিক), টিটি জাফরের ভাই কালা মিয়া ওরফে ল্যাংগা কালা, ল্যাংগা কালার ছেলে সাইফুল, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার খুরশিদ, ডেইলপাড়ার আমিন, শীলবুনিয়াপাড়ার শফিক, কুলালপাড়ার আবদুর রশিদ ওরফে ভেক্কু ও সাইফুল, কেকেপাড়ার আইয়ুব ওরফে বাট্টা আইয়ুব, নামার বাজারের ইসমাইল, কুলালপাড়ার শওকত, লেংগুর বিলের মোহাম্মদ আলী, পাল্লানপাড়ার ফারুক ও সৈয়দ করিম। এদের মধ্যে জাফর আলম দুবাইয়ে থাকে। শুধু আবুল আলী টেকনাফে আছে, অন্যরা আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থা যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে দেশের অন্যতম শীর্ষ ইয়াবা চোরাকারবারি টেকনাফের হাজী সাইফুল করিম নিহতের আগে ৩৩ ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসায়ীর তথ্য পুলিশের কাছে দিয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৮ আসামির পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পেয়েছে পুলিশ।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, নিহত সাইফুল পুলিশকে যে তালিকা দেয় তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আবদুর রহমান বদির ভাই টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মৌলভী মুজিবুর রহমান, শুক্কুর ও ফুফাত ভাই রাসেল। এছাড়া রয়েছেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, তার ছেলে টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া, ‘হুন্ডি ডন’ খ্যাত জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর, তার ছোট ভাই আবদুল গফুর, নাজিরপাড়ার ইয়াবা ডন নুরুল হক ভুট্টু ও এনামুল হক মেম্বার।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেন বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা সত্ত্বেও ‘ইয়াবা শহর’ টেকনাফে পাচার থেমে নেই। নিত্যনতুন কৌশলে চলছে ইয়াবা পাচার। একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ইয়াবা কারবারি নিহতের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এরপরও ইয়াবা কারবারের টাকার লোভে অনেকেই এমন অনাকাঙ্কিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে।
/জনকন্ঠ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-