আজিম নিহাদ :
সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেরই ধারণা শহরের প্রধান সড়ক পৌরসভার মালিকানাধীন। আবার অনেকেই জানেন এটি সড়ক ও জনপদ বিভাগের (সওজ)। কিন্তু প্রধান সড়ক এখন দুই প্রতিষ্ঠানের কারোরই নয়। বর্তমানে কউকের উন্নয়ন সংক্রান্ত ফাইলে বন্দী হয়ে সড়কটি ঘুরছে এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে।
মালিকানা পালাবদলের খপ্পরে পড়ে সড়কটির বর্তমানে বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। এতে করে কক্সবাজারকে ঘিরে সরকারের বিশাল অর্জনগুলো সড়কের খানাখন্দে বিলিন হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দীর্ঘদিন ধরে মেরামতবিহীন থাকায় জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রধান সড়কের বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। খানাখন্দে যানবাহন চলাচলে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিদিন ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। কিন্তু এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
একজন সচেতন নাগরিক জানান, প্রধান সড়ক সওজের। এ প্রতিষ্ঠানটি সব সময় প্রধান সড়ক নিয়ে অবহেলা করে। বর্তমানে সড়কটি উন্নয়নের জন্য কউক উদ্যোগ নিয়েছে এজন্য কউককে সাধুবাদ জানায়। কিন্তু তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও দীর্ঘ সময় লাগবে। এই সময়ে সড়কটি কি তাহলে সংস্কারবিহীন পড়ে থাকবে?
তিনি আরও বলেন, যেহেতু সড়কটি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ তাই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত নিয়মিত মেরামতের জন্য সওজের নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত ছিল। কারণ কউকের প্রকল্পের অর্থ ছাড় পেতে আরও অনেক সময় লেগে যেতে পারে। এখন মালিকানা হস্তান্তরের কথা বলে সওজ দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। যেটা আসলে সওজ পারে না।
নাগরিক আন্দোলনের নেতা নাজিম উদ্দিন বলেন, সড়কটি কাগজে-কলমে কউককে হস্তান্তরের আগে থেকেই খানাখন্দে ভরপুর। এখন ভাঙা সড়ক চলাচল উপযোগী করতে মেরামত করার অর্থ কোথায় পাবে কউক। তাই মেরামত করার দায়িত্ব সওজের রাখা উচিত ছিল। কারণ তাদের মেরামত সংক্রান্ত যথেষ্ট ফান্ড রয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হলিডে মোড় থেকে বাসটার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়কে টানা ১০০ মিটার রাস্তাও ভাল নেই। পুরো সড়কটি খানাখন্দে ভরে আছে। বড় বড় গর্ত হয়ে মরণ ফাঁদ তৈরী হয়েছে। এর ফলে এই সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচল করে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে।
পৌরসভার কার্যালয় থেকেই সড়কের ভাঙা অংশ শুরু। সেবামূলক এই কার্যালয়ের সামনে বড় বড় বেশ কয়েকটি গর্ত তৈরী হয়েছে। সরেজমিন ঘুরার সময় পৌরসভার সামনে থেকে শুরু করে বাসটার্মিনাল পর্যন্ত শত শত গর্ত পাওয়া গেছে। এরমধ্যে পৌরসভার সামনে, বিলকিস মার্কেটের সামনে, ফজল মার্কেটের সামনে, বাজারঘাটা, বার্মিজ মার্কেটের সামনে, কালুর দোকান বাজারের সামনে, খুরুশকুল সড়কের প্রবেশমুখে, টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে, সূর্যের হাসি ক্লিনিকের সামনে, আলিরজাহাল, সিটি কলেজ গেইটের সামনে, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের সামনে ও বাসটার্মিনাল সংলগ্ন সড়কে সবচেয়ে বেশি খানাখন্দের চিত্র দেখা গেছে।
খুরুশকুল সড়কের প্রবেশমুখে, টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে, বার্মিজ মার্কেটের সামনে ও সূর্যের হাসি ক্লিনিকের সামনের রাস্তায় সৃষ্টি হওয়া গর্তে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছে যাত্রীরা।
সূর্যের হাসি ক্লিনিকের সামনে প্রধান সড়কে সৃষ্টি হওয়া গর্ত নিয়ে ওই এলাকার ফার্নিচার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মামুন বলেন, চারদিন আগে পর পর দুটি টমটম (ইজিবাইক) উল্টে গিয়েছিল। এতে বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হয়। প্রায় সময় এই গর্তটিতে গাড়ি উল্টে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু মেরামতের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
টমটম চালক রফিকুল ইসলাম বলেন, হলিডে মোড় থেকে বাসটার্মিনাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্পট তৈরী হয়েছে যেখানে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের পাশাপাশি যাত্রীরাও চলাচলের সময় চরম আতঙ্কে থাকে। কিন্তু এ দুঃখ কে বুঝবে?
কলেজ ছাত্র তুষার মাহমুদ জানান, মাসখানেক আগে কলেজে যাওয়ার সময় টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে আমাদের টমটম উল্টে গিয়েছিল। আহত হওয়ায় ওইদিন আর কলেজে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এই সড়কে চলাচলের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ে রোগি ও বয়স্ক লোকজন। বেশি কষ্ট পায় গর্ভবতী নারীরা। যে রোগি একবার প্রধান সড়ক দিয়ে হাসপাতালে যায় সে আর দ্বিতীয়বার এই সড়ক দিয়ে আসা যাওয়া করে না। তারা বাধ্য হয়ে কলাতলী সড়ক হয়ে সদর হাসপাতাল বা অন্য বেসরকারী হাসপাতালে যায়। তবে প্রধান সড়ক ছাড়া অন্য সড়কগুলোর অবস্থাও কম ভয়াবহ নয়। তাই হাসপাতালে পৌছার আগে সড়ক নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিতে হয় রোগিদের।
আব্দুর রহিম নামের এক ব্যক্তি জানান, প্রধান সড়ক দিয়ে যাতায়াত করলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। মানুষের কষ্টের কথা কেউ চিন্তা করে না। তাই এতদিন ধরে অভিভাবকহীনের মত প্রধান সড়কটি পড়ে আছে।
টেকনিক্যাল স্কুলের পশ্চিমপাশে চৌধুরী ভবন সংলগ্ন প্রধান সড়কে সৃষ্টি হওয়া গর্তে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি এই গর্তে একটি টমটম উল্টে যায়। ওই ঘটনা সাংবাদিক ইমরুল কায়েস ফেসবুকে লাইভ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে সমালোচনার ঝড় উঠে। উদাসীনতার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের শাস্তির দাবিও তুলে সচেতন পৌরবাসী।
এরপর জুলাই মাসের শেষপ্রান্তে অনুষ্ঠিত ডিসি’র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধান সড়কের বেহাল অবস্থার চিত্র তুলে ধরে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জুতাপেটা করার হুমকি দেন মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী। অবশ্য পরেরদিন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সড়কটি সওজের নয় দাবী করে দায় সারেন নির্বাহী প্রকৌশলী।
মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, কখন প্রকল্প হবে সেটার দিকে চেয়ে থাকলে-তো পুরো সড়কজুড়ে পুকুর তৈরী হবে। চলাচলের উপযোগী করতে মেরামতের জন্য বেশি টাকার দরকার নেই। শুধু দরকার সদিচ্ছার। সওজ চাইলে সড়কটি নিয়মিত মেরামত করা কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু সওজ বা ওই সব সংস্থার দায়িত্বশীল অন্যকেউ জনগণের দুঃখ-দুর্ভোগ বুঝতে চায় না। যদি তারা এই সড়ক দিয়ে ছোট গাড়ি নিয়ে একবার চলাচল করতো তাহলে বুঝতে পারতো মানুষ কি পরিমাণ কষ্টে আছে।
আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের সমন্বয়ক এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, কখন চারলেন হবে, আধুনিক রাস্তা হবে এই স্বপ্ন না দেখিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রধান সড়কটি চলাচল উপযোগী করাই এখন প্রধান কাজ। প্রতিদিন যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে তা অতীতের সব রেকর্ডকে হার মানাচ্ছে। এই সড়ক দিয়ে যারা কর্তৃপক্ষ তাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে রিক্সা অথবা টমটমে চলাচল করলে বুঝতে পারবেন মানুষ কি পরিমাণ কষ্টে আছে। তিনি আরও বলেন, প্রধান সড়ক কোন দপ্তরের সেটা সাধারণ মানুষের বুঝার বিষয় নয়। মানুষ চায় আপাতত মালিকানা নিয়ে টানাটানি না করে সড়কটি চলাচলের উপযোগী করুক।
এদিকে গত ২৮ আগষ্ট থেকে হলিডে মোড় থেকে বাসটার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়ক গাড়ি চলাচল উপযোগী করতে মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে কউক। রাতের বেলায় মেরামত করার চিত্র দেখা গেলেও সকালে সেই মেরামতের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়না। বৃষ্টির কারণে মেরামত কাজ টেকসই হচ্ছে না বলে কউকের অভিমত।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ বলেন, কউক হলিডে মোড়-বাজারঘাটা-লারপাড়া (বাস স্ট্যান্ড) প্রধান সড়ক সংস্কারসহ প্রশস্থকরণ প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে এবং ইতোমধ্যে একনেক সভায় অনুমোদনও লাভ করেছে। খুব শীঘ্রই উক্ত প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। কিন্তু বর্তমান বর্ষা মৌসুমে এই রাস্তার বিভিন্ন অংশে ভেঙ্গে যাওয়ায় জনগনের কথা বিবেচনা করে গত ৩ ও ৪ আগষ্ট এ সড়কের সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। কিন্তু ঈদের আগে ও পরে অতিবৃষ্টির কারণে সড়কের কিছু অংশে আবারো সংস্কার কাজের প্রয়োজন হওয়ায় ২৮ আগষ্ট হতে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়েছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) লে. কর্নেল মোহাম্মদ আনোয়ার উল ইসলাম জানান, সড়ক উন্নয়নের জন্য আমাদের কোন বরাদ্দ না থাকলেও জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে গতবারের মতো এবারও সড়কের সংস্কার কাজ করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও প্রয়োজন অনুসারে করা হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-