ছাত্রলীগের কোন্দল, তিন ধারার বিরোধ প্রকাশ্য

ডেস্ক রিপোর্ট – আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। নতুন মডেলের ছাত্রলীগ করার যে ঘোষণা এসেছিল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে, সেটি তো হয়ইনি, উল্টো, ছাত্রলীগ তার আদর্শিক চরিত্র হারাতে বসেছে বলে অভিযোগ করছেন সংগঠনেরই একটি অংশের নেতাকর্মীরা।

২০১৮ সালের মের জাতীয় সম্মেলনের পর ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গোলাম রাব্বানীর নাম ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এবার ছাত্রলীগ হবে ‘নতুন মডেল’-এর। তবে এখন অবধি স্পষ্ট হয়নি সেই নতুন মডেল কী আর শীর্ষ নেতাদের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।

ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী হলেও ইদানীং ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগাতে নানা কর্মসূচির দিকে ঝোঁকার প্রবণতাকে ঘিরে সংগঠনে বিরোধ স্পষ্ট হয়েছে। আর ক্ষুব্ধরা কেউ ‘সর্বদলীয় ছাত্রলীগ’, কেউ ‘শিবির লীগ’, কেউ বা ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রলীগ’ বলে নিজের সংগঠনকে কটাক্ষ করছেন।

ছাত্রলীগের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক নকিবুল ইসলাম সুমন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ছাত্রদল-শিবির থেকে আসা ছেলেদের কারণেই  ছাত্রলীগ প্রোগ্রামে মুহিব খানের মতো ব্যক্তিরা দাওয়াত পায়। আর কোনো প্রোগ্রাম হলেই মিলাদ ও দোয়া মাহফিল করা হয়। এসব তো শিবিরের কর্মসূচি। ছাত্রলীগ তো সাম্প্রদায়িক দল না।’

‘ছাত্রলীগ একটা দেহ হলে পদপ্রাপ্ত নেতারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এখন এই নেতারা যদি ছাত্রদল-শিবিরের আদর্শের হয় তাহলে ছাত্রলীগ তো এই  ধরনের কর্মসূচিরই আয়োজন করবে।’

১৫ আগস্ট স্মরণে ছাত্রলীগের নামে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দোয়া মাহফিল ও হামদ নাতের আয়োজন নিয়ে সম্প্রতি তুমুল বিতর্ক হয়েছে। ওই আয়োজনের পোস্টারে আওয়ামী লীগবিরোধী ইসলামী ঘরানার কবি মুহিব খানের উপস্থিতির তথ্য আর পোস্টারের নকশা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। পরে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, এটা তাদের কর্মসূচি ছিল না। তবে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নাম ব্যবহার করে অন্য কে এটা করবে, সে প্রশ্নের জবাব কিন্তু আসেনি। 

নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘এটা ছাত্রলীগই করেছে। পদপ্রাপ্ত একাধিক নেতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছে, এই পোস্টারটি চারবার এডিট করা হয়েছে। তারপর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুমতি নিয়েই ছাপতে দেওয়া হয়েছে। ওই প্রোগ্রামে দাওয়াত পাওয়া শিক্ষকদের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তারাও স্বীকার করেছেন, সংগঠনের পক্ষ থেকেই তাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।’

বিভেদ যেভাবে সামনে আসে

গত বছরের জুলাইয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার ১০ মাস পর চলতি বছরের মে মাসে যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর পর ছাত্রলীগে দেখা দেয় বিভেদ। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত, ব্যবসায়ী, মাদক সম্পৃক্তরা স্থান পেয়েছে অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখায় এক পক্ষ।

এর মধ্যে ১৯ জনকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি এসেছে সংগঠনের কেন্দ্র থেকে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, এই ১৯ জন কারা সে নাম এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তারা পাশে পান না। তারা সবার জন্য নন, আছেন নিজ নিজ বলয়ের নেতাকর্মীদের জন্য। আর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বারবার বলছেন, ‘এটা শেখ হাসিনাপন্থি ছাত্রলীগ।’

সংগঠনের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, ‘বারবার এই কথা কেন বলতে হয়? তার মানে সংগঠনে নানা পন্থা তৈরি হয়েছে।’

 নেতাকর্মীদের তথ্য বলছে, মোটাদাগে তিনটি পক্ষ এখন ছাত্রলীগে বেশ ভালো রকমে সক্রিয়। একটি হচ্ছে সভাপতির পক্ষ, একটা সাধারণ সম্পাদকের পক্ষের এবং একটি বিদ্রোহী পক্ষ। এর বাইরে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসকে ঘিরেও এগিয়ে যেতে চায় একটি পক্ষ। তবে সনজিত আগ্রহ দেখান না বলে এই পক্ষটি এখনো সামনে আসেনি।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে আছেন গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাঈদ বাবু, কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন, উপদপ্তর সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন, সমাজসেবা সম্পাদক রানা হামিদ, সাবেক স্কুলবিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রমুখ।

ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের লোক বলে প্রচার পেয়েছে। তার সঙ্গে শোভনের ঘনিষ্ঠতা করিয়ে দেন গত কমিটির একজন সম্পাদক।

অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীর ঘনিষ্ঠ সংগঠনের সহসভাপতি তানজিল ভুঁইয়া তানভীর প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন বলে তথ্য মিলেছে। রাব্বানীর ওপর ব্যাপক প্রভাব আছে বলে প্রচার আছে। তানজীরের বয়সসীমা ছিল না বলে অভিযোগ করছেন আন্দোলনকারীরা।

ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিতের ফোন না ধরাকে কেন্দ্র করে আরও একটি বিভেদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শোভন এবং রাব্বানী- দুই পক্ষকেই পছন্দ করেন না, এমন নেতাকর্মীরা সনজিতকে ঘিরে একটি চক্র এগিয়ে যেতে চান। কিন্তু সনজিত আগ্রহ না দেখানোয় এই উদ্যোগ আগায়নি। সনজিত বলেছেন, গ্রুপিং তার পছন্দ না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীর লোক বলেই পরিচিত। তার অনুসারীদের সঙ্গে সনজিত অনুসারীদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ না থাকলেও চাপা উত্তেজনা আছে।

গত কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনে। কোনো কমিটিতে নিজেদের লোক ঢুকাতে না পারলে টাকা দিয়ে পদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে।

সংগঠনের একজন নেতা নাম গোপন রাখার অনুরোধ করে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে ছাত্রলীগেরই বদনাম হচ্ছে। আমাদের ভালো কাজগুলো প্রচার পাচ্ছে না। কিন্তু ঢালাও নেতিবাচক বক্তব্য প্রচার পাচ্ছে। এতে দুর্নামটা আসলে হচ্ছে ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী লীগের।’

পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিতর্কিতরা বহাল তবিয়তে

গত ২৯ মে ছাত্রলীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মাদকাসক্ত, বিবাহিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৯ জনকে অব্যাহতি দিয়ে তাদের পদ শূন্য করার ঘোষণা হয়। জানানো হয়, যাচাই-বাছাই করে পদগুলো পূর্ণ করা হবে। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো শূন্যপদগুলো ফাঁকাই রয়ে গেছে। আর যাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেই নামগুলোও না জানানোয় তৈরি হয়েছে প্রশ্ন।

কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ আছে আর ১০ মাস। এর মধ্যে ফাঁকা পদে নিয়োগে কালক্ষেপণ ক্ষুব্ধ করে তুলছে পদপ্রত্যাশীদেরও। আর তারা নতুন করে আন্দোলনে যাওয়ার হুমকিও দিচ্ছে।

ছাত্রলীগের গত কমিটির নেতা এবং বর্তমানে বিদ্রোহী পক্ষের নেতা ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নাম প্রকাশ না করা এক ধরনের গেম। পদপ্রাপ্ত কেউ যখন ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, তখন বলা হবে তুমিই তো সেই ১৯ জনের একজন।’

১৯টি পদ কবে পূরণ করা হবে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আবদুল্লাহ বিন মুন্সি বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের এখতিয়ারে নেই। শুধু সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকই এটা বলতে পারবেন।’

পদপ্রাপ্ত এক ছাত্রলীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘১৯ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলা হলেও আসলে কাউকে বাদ দেওয়া হবে না। কমিটি চলছে এবং চলবে। এরা সমাবেশসহ নানা কর্মসূচিতে দায়িত্বও পেয়েছেন। সুতরাং এদের জায়গায় কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না বলেই মনে হচ্ছে।’

পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করে আরেক নেতা বলেন, ‘বর্তমান ছাত্রলীগ হলো সর্বদলীয় ছাত্রলীগ। এখানে ছাত্রদল, শিবির সবাইকে পাবেন।’

ছাত্রলীগের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘প্রেস রিলিজ দিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে বললেও কিন্তু তাদের বাদ দেওয়া হয়নি। বিতর্কিতদের  সঙ্গে নিয়ে প্রোগ্রাম করে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকও আদর্শচ্যুত হয়েছেন।’

“নানক (আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক) ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘কমিটিতে বিতর্কিতের সংখ্যা ৪০ এর উপর হবে, যাদের ছাত্রলীগ করার যোগ্যতা নেই। আর নেতারা কিন্তু এদের নিয়েই প্রোগ্রাম করছেন।’

‘আপা (শেখ হাসিনা) কয়েকবার বলেছেন এটির (বিতর্কিতদের বিষয়টি) সমাধান করতে। কিন্তু তারা আপার কথাও মানছে না। অথচ কথায় কথায় বলে তারা আপার ছাত্রলীগ। আমরা চাই, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যদি সেপ্টেম্বর এর প্রথম সপ্তাহে এটির সমাধান না হয়ে থাকে তাহলে দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আমরা আন্দোলনে যাব।’

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে তিনদিন ধরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে এসএমএস পাঠানো হলে পাল্টা এসএমএসে তিনি বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে।’

একইভাবে ছাত্রলীগ সভাপতিকে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকেও কয়েকদিন ধরে ফোন দেওয়া হলে তিনিও ফোন ধরেননি।

কেন্দ্রীয় এই দুই নেতার বিরুদ্ধে ফোন না ধরার অভিযোগটি নতুন নয়। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার আগে তাদেরকে ফোনে পাওয়া গেলেও পদ পাওয়ার পর, বিশেষ করে বিতর্কিতদেরকে পদ দেওয়া এবং এ নিয়ে আন্দোলনের পর গণমাধ্যমকে অনেকটাই এড়িয়ে চলছেন তারা।

আরও খবর