মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী রোহিঙ্গারা : RRRC ও জেলা প্রশাসনের বৈঠক ১৮ আগস্ট

বিশেষ প্রতিবেদক :

তীব্র কূটনৈতিক টানাপোড়েনের শেষ হতে চলল।অবশেষে মায়ানমার সরকার রাজি হয়েছে ঘরছাড়া দেশছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে।

জানা যায়,কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। এখানে এগারো লাখের অধিক রোহিঙ্গার বসবাস। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা এ দেশে পালিয়ে আসেন। মিয়ানমারের নানান নির্যাতন সহ্য করে আসছিল রোহিঙ্গারা।সেদেশের সামরিক জান্তা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আবারও তোড়জোড় শুরু করেছে মিয়ানমার। নিজ দেশে ফিরে যেতে অধীর আগ্রহী অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরনার্থীরা।

ইতিমধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা নিজ উদ্যেগে রাখাইন ফিরেও গেছে। কিন্তু ক্যাম্পগুলোতে প্রত্যাবাসন বিরোধী উগ্রপন্থী ও উস্কানি দাতাদের নিবৃত করা সম্ভব না হলে ফের হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আগামী ২২ আগষ্ট ৩ হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে প্রথম ধাপে স্থল ও নৌ পথে গ্রহণ করতে প্রস্তুতি নিয়েছে মিয়ানমার সরকার।

গত জুলাই মাসের দু’দফায় মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট থু এর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেশন টিম কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন এবং রোহিঙ্গা নর-নারীদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেন। রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে অনুরোধ জানান।

ওই টিমের সদস্যরা দুই দিনে কয়েক দফায় ক্যাম্পগুলোতে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনায় অংশ নেন। মিয়ানমার সফরকারী টিমের সঙ্গে যুক্ত হন আসিয়ানের – আহা সেন্টারের ৫ সদস্যর প্রতিনিধি দল।

রাখাইনে রোহিঙ্গারা ফিরে কি কি সুবিধা ভোগ করবে, জীবন জীবিকা কিভাবে নির্বাহ হবে ও অন্যান্য অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন ডেলিগেশন টিম। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের লিফলেটও বিতরণ করা হয়।

ভয়েস অব রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দুল আমিন জানান, মিয়ানমার টিমের সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গারা নিজ জন্মভূমিতে ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে।

উখিয়ার বালুখালী ময়নার ঘোনা ১২নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মৌলভী হোসেন শরীফ ও রোহিঙ্গা দোকানদার ইমাম হোসেন বলেন, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি শুনে মনে খুশি লাগছে। যত তাড়াতাড়ি নিজ দেশে ফিরে যেতে পারি।

উখিয়ার কুতুপালং ২নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ বলেন, তাদের মৌলিক অধিকার পূরণ হলে একজন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশে থাকবে না। স্ব-ইচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যাবে।

বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা জবর মুল্লুক জানান, বর্ডার খোলা ফেলে যেভাব এসেছে সেভাবে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী। কিন্তু জানমালের নিরাপত্তার অভাবে কেউ মুখ খুলে বলতে পারছে না। কারণ ইতিপূর্বে এ ধরণের ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা বেশ কয়েক জন রোহিঙ্গা নেতা হত্যার শিকার হয়েছে।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৯ এর মাঝি মোছা আলী ও নুরুল আমিন বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার কথায় তারা খুশি হয়েছে। কারণ তারা নিজ দেশে গিয়ে বসতবাড়ীতে বসবাস করতে পারবে।

উখিয়ার থাইংখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মৌলভী হাফেজ আমির হোসেন জানান, রাখাইনে যারা মুলা দেখিয়ে দেশান্তরিত হতে কাজ করেছিল, তারাই ক্যা¤প গুলোতে নানা নির্যাতন জুলুম করছে। এখানে (ক্যা¤েপ) ছেলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নারীদের কোনো ইজ্জত নেই। জিম্মিদশায় প্রতিনিয়ত নারীর সম্ভ্রম হানি হচ্ছে। তাই অধিকাংশ রোহিঙ্গা যে কোনো ভাবে রাখাইন ফিরে যেতে আগ্রহী।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মো. ইলিয়াছ ও নুর মোহাম্মদ জানান, রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে যারা হুমকি, খুন, গুমের সঙ্গে জড়িত তারা সকলের চেনা জানা। তাদের নানা হুমকি উপেক্ষা করে নিজ উদ্যেগে অনেক রোহিঙ্গা গোপনে রাখাইন ফিরে যাচ্ছে। ক্যা¤প গুলোতে সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে গত ৯ আগষ্টও ২১ জন রোহিঙ্গা নারী, শিশু, পুরুষ মিয়ানমার ফিরে গেছে বলে তারা জানান।

তবে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বলেছে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ও নাগরিকত্বের স্বীকৃতির নিশ্চয়তা এবং তাদের উপর সংঘটিত নির্যাতনের বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজী নয়। এ অবস্থায় ফিরে না যেতে চাইলে এই দফার চেষ্টাও ফলপ্রসূ হবে কি না তা এখনও অনিশ্চিত। একই ভাবে গত বছরের ১৫ নভেম্বর উভয় দেশের ব্যাপক প্রস্ততি থাকার পরও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়নি। এ সময় কতিপয় দেশি বিদেশি এনজিওর গোপন ষড়যন্ত্র ও উস্কানি পেয়ে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বাধার মুখে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম পণ্ড হয়ে যায়।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, মিয়ানমার নিয়মিত তাদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের যাচাইকৃত তালিকা দিচ্ছে। ২২ আগষ্ট মিয়ানমার সম্প্রতি ছাড়পত্র দেয়া ৩৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম মৈত্রী সেতু দিয়ে স্থলপথে ও নাগাখুইয়া নৌপথ দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচটি মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, তিনিও শুনেছেন মিয়ানমার সরকার ৩ হাজার ৫৪০জন রোহিঙ্গা নাগরিককে স্ব-দেশে ফিরিয়ে নেবে।

এ বিষয়ে রোববার কক্সবাজার শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালামের কার্যালয়ে এক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা বিষয়ে রোববার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রধান্য পাবে।

প্রসঙ্গত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যর্পণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।এর জন্য টেকনাফের কেরুনতলীতে একটি ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে একটি অর্ন্তবর্তীকালীন শিবির তৈরিও করা হয়েছিল।সেই প্রথম দফায় ৪৮৫ পরিবারে ২ হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। আর প্রতিদিন দেড় শ’ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল মিয়ানমার।কিন্তু রাখাইনে আবারও হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ব্যর্থ হয় ওই উদ্যোগ।

এছাড়া শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর (UNHCR) এই ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের ভূমিকায় আগেই অসন্তোষ জানিয়েছে।

আরও খবর