বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পরিবার কোরবানি মাংস থেকে বঞ্চিত

ডেস্ক রিপোর্ট – এবারের ঈদে প্রশাসনের মাধ্যমে এনজিওদের দেয়া গরুর গোস্ত বেশীর ভাগ রোহিঙ্গা পরিবার পায়নি। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ ইউনুছ আরমান জানান, এ বছর এনজিওগুলো কোরবানির গোস্ত কম বিতরণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ অনেক ক্যাম্প মোটেও গোস্ত পায়নি। ঈদের নামাজের পর এসব ক্যাম্পে কান্নার রোল পড়ে যায়। তবে তিনি সারা বছরের সঞ্চয় থেকে নিজ উদ্যোগে একটি গরু কোরবানি দিয়েছেন এবং নিজের জন্য কিছু গোস্ত রেখে অবশিষ্ট গোস্ত প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছেন বলে জানান।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আয়ুব আলী মাঝি জানান, দ্বিতীয় বছরের মতো এখানে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করার সুযোগ হয়েছে। ঈদের নামাজ শেষে শুধু ইমাম, মুয়াজ্জিন নন, মসজিদে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। রাখাইনে আমরা কেউ বাবা-মা, বোনকে হারিয়েছি, আবার কেউ ভাই ও স্বজনকে হারিয়েছি। কবরে ঘুমিয়ে আছেন আমার মা। নিজে কোনো পশু কোরবানি দিতে না পারলেও অন্তত তাদের জন্য ফাতেহা পাঠ করতে পেরেছি।

উখিয়ার কুতুপালং টিভি টাওয়ারসংলগ্ন বটতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, এই বছর তেমন কোনো গোশত পাইনি আমরা। অবশ্য যেটুকু পেয়েছি, আমার ব্লকের কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা পরিবারকে ভাগ করে দিতে পেরেছি। এরপরও দুঃখ নেই। কারণ রাখাইনের চেয়ে এই রোহিঙ্গা ঝুপড়িতে আমরা শান্তিতে রয়েছি।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ লালু মাঝি জানান ভিন্ন প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, গোস্ত পেলাম কি পেলাম না তাতে দুঃখ নেই। রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হলেও আমরা নিরাপদে রাখাইনে ফিরে যেতে চাই। ঈদের নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করেছি।

বেশির ভাগ রোহিঙ্গা পরিবার গোস্ত না পেলেও কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: আবুল কালাম জানান, এ বছর এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে কোরবানির পশুর গোস্ত বিতরণ করা হয়েছে। প্রত্যেক পরিবারকে দুই কেজি করে গোস্ত দেয়া হয়। অন্তত পাঁচ হাজার পশু জবাই করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। সরকার ও এনজিওরা মিলে এসব পশু কোরবানি দিয়েছে।

একইভাবে স্থানীয়দের মধ্যেও কোরবানির পশু বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক গরু জবাই ও সুষ্ঠুভাবে গোস্ত বিতরণ করা হলে (দেড় কেজি করে) প্রায় সব রোহিঙ্গা পরিবার গোস্ত পাওয়ার কথা। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এসব গরু গেল কোথায়?

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: কামাল হোসেন জানান, ‘এ বছর কোরবানির ঈদে রোহিঙ্গাদের মধ্যে যথাসম্ভব গোস্ত বিতরণ করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত বিভিন্ন এনজিও, সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবেও কোরবানির পশু দান করা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত সোমবার ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করা হয়েছে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন রোহিঙ্গা মুসলমানরা। তারা নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও মর্যাদার সাথে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার তৌফিক চেয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেন।

টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৫ (আলীখালী, টেকনাফ)। সেখানে বাস্তুচ্যুত ৩১০৪ রোহিঙ্গা পরিবারের প্রায় ১৩ হাজার সদস্যের বাস। এবারের ঈদে এক টুকরা গোস্তও এদের কেউ চোখে দেখেনি। কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। ঈদের নামাজের পর নিজেদের অসহায়ত্বের কাছে পরাজিত এসব রোহিঙ্গা চোখের পানিতে বুক ভিজিয়ে ফিরে যান নিজেদের তাঁবু ঘরে। শিশুসন্তান তথা পরিবার-পরিজনের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কী করবে তারা?

ঈদের পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার দুপুরে একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা সামান্য কিছু গোশত নিয়ে এই ক্যাম্পে আসেন। কেউ পেয়েছে অল্প পরিমাণ। তবে অনেকে সেটুকুও পায়নি।

ওই ক্যাম্পের মাঝি মাস্টার রহিম উল্লাহ এ কথা জানিয়ে বলেন, গরু কোথায় জবেহ হয়েছে আমরা জানি না। তবে ১৫০টি প্যাকেট এই ক্যাম্পে দিয়ে গেছেন এনজিও কর্মীরা। প্রতিটি প্যাকেটে দেড় কেজি গোস্ত ছিল। তবে দুই হাজার ৯৫৪ পরিবার দেখেনি গোশত।

তিনি আরো জানান, বছরের প্রায় প্রতিটি দিন রোহিঙ্গা পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে শুধুই ডাল, কখনো কখনো শুঁটকি মাছ ইত্যাদি দিয়েই তাদের প্রতিবেলা আহার করেন। এবার সবার প্রত্যাশা ছিল কোরবানির ঈদে অন্তত গোস্ত দিয়ে সন্তান সন্ততির মুখে কিছু খাবার দিতে পারবেন কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হলো না। গত ঈদেও একই অবস্থা ছিল। তবে গোস্ত না পেলেও তাদের এটুকু স্বস্তি যে, তারা শান্তিতে অন্তত ঈদের নামাজ আদায় করতে পেরেছেন।

ক্যাম্প-২৪ এর অবস্থাও অনুরূপ। ক্যাম্প মাঝি মোহাম্মদ কামাল জানান, তার ক্যাম্পে ৮ হাজার ৫০০ পরিবারের বাস। ঈদের দিন তারা কেউ গোস্ত পাননি। মঙ্গলবার দেড় কেজি করে ২০০ প্যাকেট গোস্ত পেয়েছেন। এগুলো অল্প অল্প করে ভাগাভাগি করা হয়েছে। তবুও বেশির ভাগ পরিবার কিছুই পায়নি।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ক্যাম্প- ২৬ (মুছনি) এবং ক্যাম্প-২৭ (জাদিমোরা) টেকনাফ এলাকায় অবস্থিত। এসব ক্যাম্পের অবস্থাও অনুরূপ। বেশির ভাগ পরিবার কোরবানির গোশত পায়নি।

জাদিমোর ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ জাফর জানান, ১২ হাজার ৮৭৬টি পরিবারের মধ্যে মাত্র দুই হাজার পরিবার দুই কেজি করে গোস্ত পেয়েছে। বেশির ভাগ চোখের পানিতে ঈদ পার করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এনজিও কর্মকর্তা জানান, এই দুই ক্যাম্পে ২২৪টি গরু বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এসব গরুরগোস্ত দেড় কেজি করে বণ্টন হলেও অন্তত ২৫ হাজার পরিবার কোরবানির গোশত পেতেন। তাহলে এসব গরু গেল কোথায়?

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে টেকনাফ এলাকায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গোস্ত পায়নি বেশির ভাগ রোহিঙ্গা পরিবার। ক্যাম্পের মাঝিরা প্রায় সবাই একই কথা বলেন। তবে উখিয়া এলাকায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবারগুলো তুলনামূলকভাবে কিছু গোশত পেয়েছেন বলা যায়।

তথ্য মতে, হাতেগোনা কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার যাদের আত্মীয় স্বজন সৌদিতে রয়েছেন কিংবা ক্যাম্পে চাকরি করেন তারা কয়েকজন মিলে গরু কোরবানি দিয়েছেন।

উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ ইউনুছ আরমান জানান, এ বছর এনজিওগুলো কোরবানির গোস্ত কম বিতরণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ অনেক ক্যাম্প মোটেও গোস্ত পায়নি। ঈদের নামাজের পর এসব ক্যাম্পে কান্নার রোল পড়ে যায়। তবে তিনি সারা বছরের সঞ্চয় থেকে নিজ উদ্যোগে একটি গরু কোরবানি দিয়েছেন এবং নিজের জন্য কিছু গোস্ত রেখে অবশিষ্ট গোস্ত প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছেন বলে জানান।

আরও খবর