রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে মিয়ানমারের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা সরজমিনে দেখাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। শনিবার প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সংস্করণে এ খবর জানা গেছে।

২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। এদের সঙ্গে রয়েছেন ১৯৮২ সাল থেকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া আরও প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘদিন পার হলেও এর আওতায় কোনও শরণার্থী নিজ দেশে ফিরে যায়নি। মানবাধিকার গ্রুপগুলো দাবি করে আসছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে বসবাসের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

১৫ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী সচিব। তিন দিনের এই সফরকে ঢাকার কূটনীতিকরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন। তারা আশা করেন, প্রতিনিধি দলটি রাখাইনের সর্বশেষ অবস্থা শরণার্থীদের অবহিত করবেন। ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সহমত তৈরি করবেন।

১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এখন শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষিতে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে এমনটাই ধারণা করছেন কূটনীতিকরা।

জাতিসংঘ থেকে শুরু করে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব দেশই এই সংকটের আশু সমাধান চাচ্ছে। চীনের ভূমিকা অস্পষ্ট ছিল বরাবরই। অতিসম্প্রতি চীনও সবুজ সংকেত দিয়েছে। শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে দ্বিপাক্ষিক একটি চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সব রকমের প্রস্তুতি সত্ত্বেও মিয়ানমার রহস্যজনক কারণে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি।

গত বছর নভেম্বর মাসে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মিয়ানমার নানা অজুহাতে পুরো প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। রোহিঙ্গারা শুরু থেকেই মিয়ানমার সরকারকে অবিশ্বাস করে আসছে। তাদের কথা, আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পেলেই তারা রাখাইনে ফিরে যেতে রাজি হবে।

মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে রবিবার। পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক দেশের বাইরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সচিব বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন।

এদিকে, অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট কর্তৃক মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বারবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও স্যাটেলাইট ছবি পর্যালোচনায় রোহিঙ্গাদের পুরনো আবাসস্থলে কোনও নির্মাণ কাজের চিহ্ন দেখা যায়নি। যদিও কয়েকটি এলাকায় বাড়িঘর ভাঙা অব্যাহত রয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত রাখাইনে প্রত্যাবাসনের এলাকার স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গবেষণাটি পরিচালনা করেছে এএসপিআই। ২০১৭ সালের সহিংসতায় পুড়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও ধ্বংস হয়ে গেছে-ইউএনওস্যাট কর্তৃক শনাক্তকৃত এমন ৩৯২টি রোহিঙ্গা বসতি নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। ফলাফলে দেখা গেছে এসব বসতির মধ্যে ৩২০টির বেশি বসতি পুনগর্ঠনের কোনও আলামত নেই। কমপক্ষে ৪৫টি ক্যাম্প নির্মাণ কিংবা বর্ধিতকরণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত, প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গা কিংবা দুই ধরনের মানুষের জন্যই ক্যাম্পগুলো তৈরি হয়েছে। এছাড়া সাবেক রোহিঙ্গা বসতির ওপর ছয়টি সন্দেহমূলক সামরিক ফ্যাসিলিটি নির্মাণ ও বর্ধিত করা হয়েছে।
এএসপিআই বলছে, ইউএনওস্যাট ডাটার পাশাপাশি তারা অন্তত ৫৮টি বসতি এলাকা শনাক্ত করেছে যেগুলো ২০১৮ সালে নতুন করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালেও অন্য কিছু বসতিতে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে।

তবে সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশন্স (আসিয়ান)-এর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে। জুন মাসে সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হওয়া এএইচএ সেন্টারের প্রতিবেদনে প্রত্যাশা করা হয়েছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫ লাখ রোহিঙ্গা সেখানে ফিরতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো রাখাইনের চলমান সংঘাতকে এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ করছে। আর জাতিসংঘ বলছে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি রাখাইনে। 

আরও খবর