ইয়াবা পাচারে নতুন সংযোজন ‘রোহিঙ্গা’

মুহিবুল্লাহ মুহিব :

দেশের ইয়াবার প্রবেশদ্বার খ্যাত টেকনাফে মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। তখন থেকেই ইয়াবা বিরোধী অভিযান জোরদার হয়।

ইয়াবার আস্তানা ও কারবারিদের একের পর এক হানায় নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। মাদক নির্মূল করতে গিয়ে টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে ১০১ জন মাদক কারবারী নিহত হয়। এর মাঝে পুলিশের ৭৪ জন, বিজিবির সঙ্গে ১৮ জন, র‌্যাবের সঙ্গে ৭ জন নিহত হন। তবে নিহতদের মধ্যে নারীসহ অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছেন। এছাড়া আইনশৃংখলা বাহিনীর ভয়ে ১০২ মাদককারবারী আত্মসর্ম্পন করেছে। অন্যান্য মাদক কারবারীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

জানা যায়, ইয়াবা কারবার কিছুটা থামতে না থামতেই রোহিঙ্গা শিবির ভিত্তিক ইয়াবা সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ওঠে। সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার এখনো থামেনি, তবে আগের মতো ইয়াবার বেপরোয়া গতি এখন আর নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানে কারবারিরা তেমন সুবিধা করতে পারছেন না।

তবে রোহিঙ্গা ইয়াবা সিন্ডিকেট এখনো মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় চালান দেশে ঢুকাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নতুন করে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারে যুক্ত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আর্ত্মসমপণে ইয়াবা পাচার থামছে না বরং পাচারে নতুন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, সহজলভ্য ও সস্তা মাদক বহনকারী হয়ে উঠেছে শিবিরের রোহিঙ্গারা। পাচারকারী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারীরা।

এদিকে বিভিন্ন সংস্থার গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রোহিঙ্গা আসার পর শরণার্থী ক্যাম্প এলাকায় কক্সবাজারে ইয়াবা আটকের পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়ে গেছে মাদক মামলা ও আসামির সংখ্যাও। তবে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে হটলাইনে যাওয়ায় চলতি বছরে মাদক পাচার কিছুটা কমেছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে মাদকের চাহিদার কারণে সরবরাহও আছে, কিন্তু সরবরাহ বন্ধ করা না গেলে চাহিদা বাড়তেই থাকবে, যার কারনে বাংলাদেশকে মাদক পাচারের রুট হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে আটক হওয়া রোহিঙ্গারা পরিচয় লুকানোর কারণে মাদক সংক্রান্ত মামলায় রোহিঙ্গা আটকের সঠিক পরিসংখ্যা জানা কঠিন হয়ে পড়েছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত এক বছরে কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া গড়ে উঠেছে। ইয়াবা মজুতের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে জনবহুল এই ক্যাম্পগুলো। তবে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবা কারবারির তালিকায়ও ১৩ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গার নাম রয়েছে।

স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতারা জানান, ইয়াবা ব্যবসায় বেশি জড়াচ্ছে শিবিরের স্বামীহারা নারীরা। তারাই এখানে সবচেয়ে অসহায়। তারা সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে ওপারে যাওয়া-আসার নিরাপদ পথ চেনে।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ডেভলপমেন্ট কমিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোঃ আলমের মতে, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রোহিঙ্গাদের এ কাজে জড়াচ্ছে। তবে তাদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রচারনা চালানো হচ্ছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের পর ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী আটক হয়েছে। তবে মাদক বিরোধেী অবস্থানে ২০১৯ সালে অনেকটা কমে এসেছে। রোহিঙ্গা শিবিরকে নিরপদ মনে করে অনেক ইয়াবা কারবারি সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘সীমান্তের ইয়াবা বন্ধে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করছেন। মাদক বিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে ৭৪ জন শীর্ষ ইয়াবা কারবারি নিহত হয়েছে এবং ১০২ জন কারবারি আত্মসমর্পন করেছেন। এছাড়া অনেক ইয়াবা কারবারি পালিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর তৎপরতায় স্থানীয় লোকজন এখন ইয়াবা কারবারে জড়াতে চাচ্ছেনা। তবে রোহিঙ্গা এখন নতুন করে ইয়াবা পাচারে চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গা শিবিরে ইয়াবা সিন্ডিকেট ও কারবারিদের পুলিশ খোঁজ নিচ্ছে এবং তাদের মাঝে মাদক বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।’

র‌্যাব-১৫ টেকনাফ ক্যাম্প ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, ‘দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান শুরুর পর স্থানীয় অনেক ইয়াবা পাচারকারীও রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। যে কারণে শিবিরগুলোতে র‌্যাবের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। মাদকের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা।’

টেকনাফস্থ ২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে.কর্ণেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খাঁন বার্তা২৪.কমকে বলেন, সীমান্তে ইয়াবার পাচার রোধে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। গত ৬ মাসে বিজিবির অভিযানে ৪২ লক্ষ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে এবং ১৮ জন ইয়াবা কারবারি বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই রোহিঙ্গা নাগরিক।

আরও খবর