আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার
হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্রতীরবর্তী মেরিন ড্রাইভে গত প্রায় ৫ মাস ধরে যান চলাচল করছে সামুদ্রিক জোয়ারভাটার মর্জির উপর নির্ভর করে।
সাগরে ভাটা থাকলেই কেবল মেরিন ড্রাইভ সচল, জোয়ার থাকলে শহরের সাথে বিচ্ছিন্ন। এভাবে প্রতিদিন দিনের অর্ধেক সময় বন্ধ থাকছে যানবাহন চলাচল। জোয়ার-ভাটার সময় বুঝে চলাচল না করলে সামুদ্রিক জোয়ারে তলিয়ে যায় যানবাহন।
এছাড়া ইঞ্জিনসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশে পানি ঢুকে প্রতিদিন বিকল হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য যানবাহন।
মেরিন ড্রাইভের সাথে শহরের একমাত্র সংযোগ সড়কটি সংস্কারের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে পৌর কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখায় গত প্রায় ৫ মাস ধরে চলছে এ ভোগান্তি। এর ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ছাড়াও কলাতলীর দক্ষিণ অংশের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ছেন অথচ সড়কটির সংস্কার কাজের বাকি আরো প্রায় অর্ধেক।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র গত জানুয়ারি মাসের শেষদিকে এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৩ মাসের জন্য কলাতলীর গ্রামীণ সড়কটি সংস্কারের জন্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন।
যথারীতি ২ ফেব্রুয়ারি থেকে সড়কটি বন্ধ করে দেয়া হলে শহরের সাথে মেরিন ড্রাইভ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ মেরিন ড্রাইভের বেইলি হ্যাচারি পয়েন্ট থেকে সমুদ্র সৈকতে ওঠানামার একটি বিকল্প পথ তৈরি করে।
একইভাবে কলাতলী পয়েন্টেও মাটি দিয়ে একই ধরনের পথ তৈরি করা হয় কিন্তু সমুদ্র সৈকত ধরে সনাতনী উপায়ে যানবাহন চলাচল নির্ভর করছে এখন সমুদ্রের জোয়ার ভাটার মর্জির উপর।
প্রতিদিন দুইবার সামুদ্রিক জোয়ারের সময় ৫/৬ ঘণ্টা করে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে শহরের একাংশের হাজার হাজার মানুষ ও শত শত যানযাহন সাময়িকভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
এছাড়া সময় না বুঝে সমুদ্র সৈকতে চলাচল করতে গিয়ে সামুদ্রিক জোয়ারের ধাক্কায় প্রতিদিন দুর্ঘটনাও ঘটছে। সৈকতে আটকে যাচ্ছে যাত্রীবাহী যানবাহন। আর এর সুযোগ নিচ্ছে স্থানীয় কিছু মাদকাসক্ত যুবক ও টাউট-বাটপার। তারা সৈকতে আটকে পড়া গাড়ি ঠেলে সামান্য পথ তুলে দেয়ার বিনিময়ে দাবি করছে মোটা অংকের অর্থ। এমনকি ৫ মিনিটের কাজের জন্য দাবি করা হয় ৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ অজুহাতে যাত্রীবাহী অটোরিকশা ও ই-বাইকগুলোও গাড়িভাড়া দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ী সমাজ ও স্কুলগামী শিশু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা।
স্থানীয়রা জানান, কলাতলীর দক্ষিণে মেরিন ড্রাইভের ২ কিলোমিটারের মধ্যে দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোনো হাইস্কুল নেই। তাই ওই অংশের বেশিরভাগ শিশুকে ওই সড়কটি পার হয়ে কলাতলী উত্তর অংশের স্কুলে আসতে হয়।
এছাড়া ব্যবসায়ীদেরকে প্রতিদিন শহর থেকেই মালামাল আনতে হয়। কিন্তু ৫ মাস ধরে কলাতলী সংযোগ সড়কটি বন্ধ থাকায় কিছু পথ পায়ে হেঁটে ও কিছু পথে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুণে গন্তব্যে পৌঁছাতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় হাজার হাজার মানুষকে।
কলাতলী সৈকত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র ও দরিয়ানগর এলাকার বাসিন্দা রবিউল ও একই স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র নাহিদ জানায়, আগে স্কুলে যাতায়াত করতে তাদের প্রতিজনকে ভাড়া দিতে হতো ৫ টাকা করে ১০ টাকা। আর এখন দিতে হয় চারগুণ বা ২০ টাকা করে ৪০ চল্লিশ টাকা। এরপরও অনেক পথ পায়ে হাঁটতে হয়। তবু ঠিকমতো গাড়ি পাওয়া যায় না।
রাস্তা বন্ধ থাকায় ও জোয়ারভাটার কারণে ঠিকসময়ে স্কুলে পৌঁছা যায় না বলে গত প্রায় ৫ মাস ধরে অসংখ্য শিশু নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করতে পারছে না বলে জানান কলাতলী হাইস্কুলের শিক্ষক ছৈয়দ নূর ও সৈকত কেজি স্কুলের শিক্ষক হুমায়ূন কবীর।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. আবু তাহের সওদাগর বলেন, ‘কলাতলী সড়কটির সংস্কার কাজ শুরুর পর থেকেই কলাতলীর দক্ষিণ অংশের ব্যবসায়ী সমাজ চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছে। মালামাল পরিবহণ খরচ আগের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বেশি পড়ায় ক্রেতাদের সাথে নিত্য বাকবিতণ্ডা হচ্ছে।’
একইভাবে মেরিন ড্রাইভের অর্ধশতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলো আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে বলে জানান হিমছড়ির পর্যটন ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রের তীর ধরে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি গত ২০১৭ সালের ৬ মে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে ১৯৯১-৯২ সালে সড়ক প্রকল্পটি গ্রহণের পর থেকেই নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু মেরিন ড্রাইভের স্টার্টিং পয়েন্ট কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে বেইলি হ্যাচারি মোড় পর্যন্ত প্রায় ১৩শ’ মিটার সড়ক বিগত ২০০০ সালে সামুদ্রিক ভাঙনে বিলীন হয়ে গেলে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে সড়ক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০৫-০৬ সালে কলাতলী গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সংকীর্ণ সড়কটিকে সামান্য প্রশস্ত করে মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি সংস্কার না হওয়ায় সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে পৌর কর্তৃপক্ষ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
এ পথে বর্তমানে হাজার হাজার পর্যটক ছাড়াও প্রতিদিন সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলাচলকারী দেশের ও বিদেশের ভিভিআইপিসহ স্থানীয় অধিবাসীরা চলাচল করেন।
বিশেষ করে কলাতলী ও এর দক্ষিণ অংশ দরিয়ানগর, হিমছড়িসহ বিশাল এলাকার সাথে শহরের একমাত্র সড়ক যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় এসব এলাকার হাজার হাজার অধিবাসীকে পড়তে হচ্ছে চরম দুর্ভোগের মুখে। অথচ তিন মাসের জন্য সড়কটি বন্ধ করা হলেও গত প্রায় ৫ মাসে কাজ হয়েছে মাত্র অর্ধেক।
কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল আলম জানান, ইউজিআইআইটি প্রকল্পের অধীনে অন্য আরো দু’টি সড়কের সংস্কার কাজসহ প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি সংস্কারের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১৮ জুন) পর্যন্ত সড়ক সংস্কার প্রকল্পের কাজ প্রায় ৫৫ ভাগ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ হতে আরো মাসখানেক সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বার বার প্রকল্পের ডিজাইন পরিবর্তন এবং সড়কের ড্রেইন নির্মানে এলাকাবাসীর জমি না ছাড়ার কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। ফলে গত প্রায় পক্ষকাল আগে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য আরো ৪৫ দিন সময় বাড়িয়ে নতুন কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে।’
তবে আগামী এক মাসের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে কিনা তা নিয়ে স্থানীয়রা সন্দিহান।
কলাতলীর কৃষক নফু মাঝি কক্সবাজার পৌরসভা কর্তৃপক্ষের দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘তিন মাসের জন্য রাস্তা বন্ধ করে ৫ মাসেও যারা অর্ধেক কাজ শেষ করতে পারে না তারা কী করে একমাসে বাকি কাজ শেষ করবে?’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-