বিশেষ প্রতিবেদক :
বিভিন্ন উপায়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। তাদের কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছে। আবার কেউ বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কৌশলে পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে এমন কয়েকটি এনজিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মানবিক সহায়তা পেলেও অনেকে মনে করছেন সহসা তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন হবে না। তাই ক্যাম্পে বসবাসের একঘেয়েমি জীবন থেকে বের হয়ে তারা স্বাধীনভাবে চলতে চায়। এমন চিন্তায় অনেকে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ইন্টার সেক্টর কমিউনিকেশনের (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস জানান, রোহিঙ্গাদের অনেকে উন্নত জীবনের জন্য দেশের বাইরে যেতে চায়। আবার অনেকের আত্মীয়-স্বজন বিদেশ থাকার কারণে তারা সেসব দেশে পাড়ি দিতে তৎপর।
এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে নতুন সংকট সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন এই কর্মকর্তা।
এনজিও সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট সীমানায় ঘিরে রাখতে না পারায় তারা বনজঙ্গলসহ বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে সহজে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা এখন কৌশল পাল্টেছে। তারা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়ছে। এরপর বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সঙ্গে বসবাস করছে। পরে তৈরি করছে পাসপোর্ট। আর উড়াল দিচ্ছে বিদেশে। এ সুযোগে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের করে বিদেশে পাচার করতে গড়ে উঠেছে ক্যাম্প ভিত্তিক দালাল চক্রও।
সূত্র জানায়, সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের পৃথক ২১টি অভিযানে গত দেড় মাসে প্রায় ৬০০ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। সর্বশেষ গত ৬ জুন কক্সবাজার শহরের লিংকরোড থেকে ১৮ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। এর আগে, গত ৩০ মে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়ার সময় দুই দালালসহ ৫৮ জনকে আটক করে কোস্টগার্ড । এর মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ২৬ জন নারী ও ১০ শিশু রয়েছে। তারও আগে ২০টি অভিযানে ৫১৭ রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফিরিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে, ৩২ দালালকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
শুধু সাগর পথে রোহিঙ্গারা পালানোর চেষ্টা করছে না, তারা বাংলাদেশি পাসপোট নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেয়ারও চেষ্টা করছে। গত ১০ মে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে পালানোর সময় ২৩ জন রোহিঙ্গা ধরা পড়ে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে আরও অর্ধশত রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে।
কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম নাসিম জানান, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের করা ৩০০ আবেদন জব্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা মেয়েরা প্রথমে কিছুদিন স্থানীয়দের সঙ্গে বসসাস করে। পরে তারা স্থানীয় ভাষা রপ্ত করে, স্থানীয়দের মতো পোশাক পরে। আচার-আচরণ সবকিছু স্থানীয়দের মতো শিখে ফেলে। এরপর স্থানীয়রা মা-বাবা সেজে বিভিন্ন কাগজপত্র সংগ্রহ করার পর পাসপোর্ট অফিসে এসে হাজির হয়। হজে যাবে বা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবে বলে পাসপোর্ট নেয়ার চেষ্টা করে। এভাবে নানা কৌশলে পাসপোর্ট নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা।
সূত্র জানায়, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা নারীরা বিদেশ পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া তাদের পছন্দের প্রথম গন্তব্য।
উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারীদের নিয়ে কাজ করে নারী জাগরণ সংস্থা। এই সংস্থার প্রধান নির্বাহী শিউলি শর্মা বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের অনেকেই মালয়েশিয়া গিয়ে বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর। তারা মনে করে, মালয়েশিয়া যেতে পারলে তাদের ভালো বিয়ে হবে। এ ধারণা তাদের ঢুকিয়ে দিয়েছে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট। ফলে তাদের অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী।
অপর একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে এখন মানবপাচারকারীদের তৎপরতাও বেড়েছে। তাছাড়া কিছু রোহিঙ্গা আছে, যাদের স্বজন মালয়েশিয়া অবস্থান করেছ। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত স্বজনদের মালয়েশিয়া নেয়ার জন্য যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রেও মানবপাচারকারীরা সহায়তা করছে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, একসঙ্গে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। নানা কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে তারা। অনেকে বেরও হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে বের হতে না পারে সেজন্য সাধ্যমতো প্রচেষ্টা রয়েছে। পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা বের হওয়ার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্ট এড়িয়ে পাহাড়-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এলাকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
‘তারা এখন স্থানীয় ভাষা শিখে গেছে। পোশাক স্থানীয়দের মতো পরিধান করছে। এছাড়া অনেকে স্থানীয়দের সঙ্গে করে বা স্থানীয়দের ভীড়ে কৌশলে পালানোর চেষ্টা করছে,’ বলেন তিনি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন জানান, রোহিঙ্গারা স্বেছায় পাচার হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় পালিয়ে যেতে চায় তাদের ধরা কঠিন। আর এর মধ্যে মানবপাচারকারীরা সহযোগিতা করলে আরো কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, সাধারণত চেকপোস্ট বসানো হয়েছে রাস্তায়। রোহিঙ্গারা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে পাহাড় জঙ্গল, খাল বিল দিয়েও পালিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ হলে সেখান থেকে রোহিঙ্গারা সহজে বের হতে পারবে না।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-