কালেরকন্ঠ :
দেশের মাদক সাম্রাজ্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হাজি সাইফুল করিম এখন পুলিশ হেফাজতে আছেন। শিগগিরই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন।
ঈদের পর ইয়াবা কারবারিদের দ্বিতীয় পর্বের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনিও থাকছেন। পুলিশের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে সাইফুলের ব্যাবসায়িক অংশীদার সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি ও তাঁর স্বজনরা আত্মসমপর্ণ করবেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অবশ্য সাইফুলের বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন। জানতে চাইলে গতকাল তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেকনাফ সীমান্তের মোস্ট ওয়ান্টেড ইয়াবা ডন হাজি সাইফুল করিমের পুলিশ হেফাজতে থাকার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অন্যদের সঙ্গে হাজি সাইফুলেরও থাকার কথা ছিল। তবে নিজেকে সমর্পণ না করে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান।
এর পর থেকে তিনি ইয়াঙ্গুন ও দুবাইয়ে অবস্থান করতেন। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর গত ২৫ মে দেশে ফেরেন হাজি সাইফুল। পরিবারের চাপে তিনি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন।
কে এই সাইফুল করিম : কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার শীলবুনিয়াপাড়ার চিকিৎসক মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাইফুল করিম। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ইয়াবা ডিলারদের কাছে তিনি ‘এস কে’ নামে পরিচিত। একসময় পারিবারিকভাবে তেমন অর্থবিত্ত ছিল না সাইফুলের পরিবারের। বাবার পল্লী চিকিৎসা ও ফার্মেসিই ছিল পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। তবে ২০০৮ সালের পর হঠাৎই অবস্থার পরিবর্তন হয়। এ সময় ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েন হাজি সাইফুল করিম। হয়ে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। চট্টগ্রামে কয়েকটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, কক্সবাজারে আবাসিক হোটেলসহ নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ আছে তাঁর।
শীর্ষ এ ইয়াবা কারবারি হাজি সাইফুল একসময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একা ইয়াবা কারবার সামাল দিতে হিমশিম খাওয়ায় যুক্ত করেন ভাই রেজাউল করিম, রফিকুল করিম, মাহাবুবুল করিম ও আরশাদুল করিম মিকিকে। পরিবারের অন্তত ১০ সদস্যের সমন্বয়ে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন এক শক্তিশালী ইয়াবা নেটওয়ার্ক। সাইফুল বিয়ে করেন টেকনাফের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মো. আবদুল্লাহর বোনকে। ইয়াবার এ সিন্ডিকেটে তাঁর দুই শ্যালক টেকনাফ বিএনপির নেতা জিয়াউর রহমান ও আব্দুর রহমানকেও যুক্ত করেন তিনি। বিপুল পয়সা-কড়ির মালিক বনে যাওয়ায় তিনি সহজেই প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিজের পকেটে রাখতে সক্ষম হন।
বদির সঙ্গে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক : কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে দেশের শীর্ষ ইয়াবা ডন হাজি সাইফুল করিমের ছিল ঘনিষ্ঠ ব্যাবসায়িক সম্পর্ক। আব্দুর রহমান বদি প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সাইফুলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তখন দেশের ইয়াবা বাজারে ওই সিন্ডিকেটটি সাইফুল-বদি সিন্ডিকেট নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তখন থেকেই মূলত বদির পরিবারের সদস্যরাও কোমর বেঁধে ইয়াবা কারবারে নেমে পড়ে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত সংসদ নির্বাচনের আগে টেকনাফ মাঠে সাইফুলের সঙ্গে আমার দেখা হয়। এ সময় তিনি (সাইফুল) আমাকে বলেছেন, বদি তাঁর কিছুই করতে পারবে না। কিছু করতে চাইলে উল্টো বদিই ফেঁসে যাবেন বলে তিনি দাবি করেন।’
পরিবারের চাপেই আত্মসমর্পণ : এদিকে হাজি সাইফুল করিমের প্রতিবেশীরা জানায়, পুলিশের আহ্বানে সাইফুল আত্মসমর্পণ না করায় প্রশাসন ওই পরিবারের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করে। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা সাইফুলকে আত্মসমর্পণ করতে অনবরত চাপ দিতে থাকে। এর একপর্যায়ে সাইফুল আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন।
গত ৩ মে শুক্রবার রাতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে হাজি সাইফুল করিমের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় সাইফুলের দুই ভাই রাশেদুল করিম ও মাহবুবুল করিমকে আটক করে পুলিশ। তাঁরা দুজন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে পারিবারিক ইয়াবা কারবার আড়াল করতেন বলে জানা গেছে। তাঁদের আরেক ভাই সাংবাদিক জেড করিম জিয়াও তাঁদের পারিবারিক ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্য। সাইফুলের ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ মনির টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র। তিনিও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সাইফুল পরিবারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য, কক্সবাজারে সাইফুলের যে আবাসিক হোটেল আছে, তাঁর ব্যবস্থাপককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সাইফুলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি অস্ত্র ও বিপুল ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ।
এবারও বাদ থাকছেন বদি? : গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারীর উপস্থিতিতে টেকনাফের শীর্ষ ১০২ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করে। ওই অনুষ্ঠানে তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের অনেকেই যোগ দেয়নি। তবে এবার অনেকের আত্মসমর্পণের কথা শোনা গেলেও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি, তাঁর ভাই মৌলভি মুজিবুর রহমান, ঘনিষ্ঠ ইয়াবা সহচর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ ও তাঁর ছেলে সদর ইউপির চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মওলানা রফিক উদ্দিন ও তাঁর ভাই বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মওলানা আজিজ উদ্দিনের মতো বেশ কয়েকজনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-