ধনীদের পক্ষে নির্লজ্জভাবে অবস্থান গ্রহণ করায় বাংলাদেশ ব্যাংককে আদালতের তিরস্কার

ধানের চাহিদা কমে যাওয়ায় ও মূল্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশের কৃষকেরা মারাত্মক সমস্যায় পড়ে গেছেন। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে কয়েকজন কৃষক ক্ষোভে তাদের ফসলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।‘সুপার পারফর্মিং’ অর্থনীতি হিসেবে অভিহিত দেশে কৃষি খাতের এমন অবস্থায় লোকজন হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়ে গেছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সরকার, অন্তত এখন পর্যন্ত, দৃশ্যত কৃষি খাতকে রক্ষার জন্য অর্থপূর্ণ কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি।কৃষকেরা যখন এমন দুর্দশায় পড়েছে, ঠিক তখন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের স্বস্তি দিতে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে একটি হলো দীর্ঘ দিন ধরে বকেয়া থাকা ঋণের সুদের হার হ্রাস করা। এটা আর যাই হোক, অন্তত সময়োচিত হয়নি।

আদালত বলল, যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঋণ খেলাপিরা তাদের গালে চপেটাঘাত খেয়েছে যখন হাই কোর্ট এই স্বস্তিদায়ক ব্যবস্থা স্থগিত করেছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তীব্র সমালোচনা করেছে।ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ও বিরোধী দলের দুর্বল অবস্থার কারণে সরকার কৃষকদের সমস্যা সমাধানের কোনো চাপ অনুভব করছে না। বস্তুত কৃষকদের মধ্যেই শিকড় নিহিত বলে গর্ব করলেও আওয়ামী লীগ ক্রমবর্ধমান হারে ধনীমুখ দলে পরিণত হচ্ছে।

বাংলাদেশে অতিধনীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিবেচনা করলে ঋণ খেলাপিদের যে ছাড় দেয়া হয়েছে তা বিস্ময়কর নয়। অর্থমন্ত্রী নিজে একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের সদস্য এবং ঢাকার গত দুই মেয়র সফলভাবে তৈরী পোশাক শিল্পের নেতৃত্বে ছিলেন।বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী নেতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার বিপদ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার চর্চা এখানে অনেক দিনের এবং তা প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ঋণ খেলাপিরা রাজনৈতিক তহবিলের উৎস। তাদের অনেকে নীতিনির্ধারণী কাঠামোর অংশবিশেষ।করপোরেট ঋণ খেলাপিদের স্বস্তি দেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপটিতে বিস্ময়ের কিছু না থাকলেও হাইকোর্টের তা বিরোধিতা টাটকা বাতাস হিসেবে এসেছে।ধনী লবির পথ বন্ধ করে দিয়ে বিচার বিভাগ শক্তি প্রদর্শন না করলেও যথেষ্ট সাহস প্রদর্শন করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংককে ভৎর্সনা

বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিট পিটিশন শুনানিকালে হাই কোর্ট জানায়, গত ১৬ মের সার্কুলারের আলোকে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার জন্য বড় বড় ঋণ খেলাপিকে আরো সুযোগ দেয়া হলে দেশ থেকে আরো ১০০,০০০ কোটি টাকা পাচার হয়ে যেতে পারে।মোট ঋণের মাত্র ২ ভাগ পরিশোধ করেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ নিয়ে ঋণ খেলাপিদের আরো ঋণ গ্রহণের সুবিধা হাই কোর্ট বন্ধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের ১০ বছর মেয়াদে তাদের ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ দিয়ে আরো ঋণ গ্রহণের সুযোগ দিয়েছিল ওই সার্কুলারে। আদালত ২৩ জুন পর্যন্ত ওই সার্কুলার স্থগিত করেছে।বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারটি স্থগিত চেয়ে সুশীল সমাজের সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের দায়ের করা রিটের জবাবে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় ঋণ খেলাপিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, অথচ ছোট ঋণগৃহীতাদের হয়রানি করছে। এটা ভালোদের শাস্তি দিয়ে মন্দদের আনুকূল্য প্রদর্শন করার মতো বিষয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩,৩৭০ কোটি টাকা।

ফসল মাঠে পুড়িয়ে দেয়া

এদিকে সরকার কৃষি খাতের ঘটনায় কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে। দাম কমে যাওয়ায় লোকসান দিয়ে ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদেরকে। কৃষকদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় ‘দক্ষ সরকারের’ ভাবমূর্তিতে টোল পড়েছে।সরকার আমদানিকৃত চালের ওপর শুল্ক বাড়িয়েছে। এর ফলে দুর্দশা লাঘব হবে। তবে ফসল থেকে প্রাপ্ত আয়ের চেয়ে মুজুরদের শ্রমের মূল্য বেশি হওয়া যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে কৃষকদের সহায়তা করতে নগরের তরুণরা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছে। এতে প্রমাণিত হয়, কৃষকদের অবস্থা জনসাধারণের নজরে ধরা পড়েছে।

অগ্রাধিকারের বিষয়

দুটি সিদ্ধান্ত একসাথে নিলে দেখা যাবে, কৃষিনীতির ক্ষেত্রে সরকার অবহেলা প্রদর্শন করেছে আর করপোরেট খাতের ঋণ খেলাপিদের ক্ষেত্রে দ্রুত ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে।এই ভারসাম্যহীনতার সুযোগ বিরোধী দলগুলো গ্রহণের চেষ্টা করলেও বাস্তবতা হলো এই যে তারা দন্তহীন। রাজনৈতিক বিরোধীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সবচেয়ে কম উদ্বিগ্ন।পরিস্থিতি কোনো ধরনের গণবিক্ষোভের হুমকি সৃষ্টি করেনি। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারও নিরাপদ অনুভব করেছে। অবশ্য হাই কোর্টের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ভর্ৎসনা শুনেছে, তাতে করে সরকারের কর্তব্য হয়ে পড়েছে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার।

আরও খবর