একরাম হত্যার এক বছর: কেউ কথা রাখেনি

নুরুল করিম রাসেল :

সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের দুজন প্রভাবশালী সিনিয়র মন্ত্রী-নেতা একরাম হত্যার পর ফোন করে বলেছিলেন ভুল হয়েছে। সাংবাদিকদের সাথে আর কথা বলবেন না। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আপনাকে দেখা করিয়ে দেব। প্রধানমন্ত্রীকে সব কথা খুলে বলবেন। তাহলে আজ একবছর পার হয়ে গেল। কেন প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডাকলেন না। একরামতো প্রধানমন্ত্রীকে মা হিসাবে জানতেন। তাহলে মা হয়ে কেন উনি সন্তানের খবর নিলেন না। আমাদের খবর নিলেন না।

এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবী। একরাম হত্যার বিচার চাই, আজীবন বিচার চেয়ে যাব। আর কোন চাওয়া নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিচারটা করে দেক। তিনি বলেন এখনো আশায় আছি প্রধানমন্ত্রী কবে ডাকবেন।
টেকনাফে একবছর আগে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত একরাম কাউন্সিলরের স্ত্রী আয়েশা খাতুন আবেগাপ্লুত কন্ঠে কথা গুলো বলছিলেন। বলেন দায়িত্বশীল মন্ত্রী-নেতাদের নাম উল্লেখ করে বলেন তাদের কথামতো মোবাইল বন্ধ রেখেছিলেন। সাংবাদিকদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শনিবার বিকালে টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়া এলাকায় একরামের বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল তার স্ত্রী আয়েশার সাথে। এসময় ৯ম ও ৭ম শ্রেনীতে পড়–য়া তার দুই মেয়ে তাহিয়াত ও নাহিয়ান তার পাশেই ছিলেন। এক বছর পরও একরামের দুই মেয়ে স্বাভাবিক হতে পারেনি।
আয়েশা আরো জানান, কষ্ট হয় প্রতিটা মুহুর্ত। মেয়েরা এখনো তাদের বাবার পরিধেয় আধোয়া কাপড় ধুতে দেয়নি। সেই কাপড় থেকে বাবাকে অনুভব করার চেষ্টা করেন। টেকনাফ বর্ডার গার্ড স্কুলে ৯ম ও ৭ম শ্রেনীতে পড়ছে তারা। মেয়েদের পড়ার সুবাধে একরাম সেই স্কুলের পরিচালনা কমিটিরও সদস্য ছিলেন। বর্তমানে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুই মেয়ের পড়ালেখা অবৈতনিক করে দিয়েছেন বলে জানালেন। একরামের শূন্য পদে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন ছোট ভাই এহেতেশামুল হক। তিনি কাউন্সিলরের মাসিক ভাতার টাকা একরাম পরিবারকে দিয়ে দেন। তা দিয়ে এবং আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় কোন রকমে দুই মেয়ে নিয়ে সংসার চলছে বলে জানান।

কঠিন সময় পার করার কথা স্মরণ করে বলেন, একরাম হত্যার কয়েকমাস পর ঘটনায় জড়িত বাহিনীর এক কর্মকর্তা দেখা করে নানা কথা বলেছিলেন। পরোক্ষভাবে হুমকিও দেন। বলেছিলেন মোবাইলটা দিয়ে দেন ২০ লাখ টাকা দেব। যে মোবাইলে একরামের শেষ কথোপকথন রেকর্ড রয়েছে। দিনের ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ছিলেন তিনি একরামদের বাড়িতে। বিভিন্ন ভাবে হুমকি দেন। বলেছিলেন বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় রোড এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তিনি ভীত হলেও সে কথায় রাজী হননি। মোবাইল দেননি। কোন টাকা পয়সাও নেননি। এমনকি তার আত্মীয়স্বজনদেরও গতিবিধি নজরে রাখা ছাড়াও নানা ভাবে হুমকির মধ্যে রেখেছিলেন বলে জানান।

প্রসঙ্গত গতবছরের ২৬ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন পৌরসভার ৩বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর ও ১৩বছর ধরে উপজেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা একরামুল হক। এর কয়েকদিন পর একরামের স্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে একরামের শেষ কথোপথন ও বন্দুকযুদ্ধের সময়কার একটি অডিও রেকর্ড সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরলে গোঠা দেশ তোলপাড় হয়।

সেই অডিও রেকর্ডের তার মেয়ের কন্ঠের বাবাকে বলা “আব্বু তুমি কান্না করতেছ যে” এখনও দেশবাসীর কানে বাজে। একরামের স্ত্রী দাবী করেছিলেন মাদক বিরুধী অভিযানের নামে পরিকল্পিতভাবে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার একবছর পরও তিনি সেই দাবী জানিয়ে বলেন কোন একটি পক্ষের ইন্ধনে পরিকল্পিত ও নাটকীয়ভাবে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে কারা তার স্বামীকে হত্যা করলো। কি কারণে হত্যা করলো।

ঘটনার পর কক্সবাজার র‌্যাব-৭ মাদক বিরোধী অভিযানের সময় র‌্যাব সদস্যদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী একরাম নিহত হয়েছে দাবী করেন। এসময় ইয়াবা-অস্ত্র উদ্ধারের দাবী করা হয়। তবে র‌্যাব এর প্রেরিত এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একরামুল হকের ঠিকানা দেখানো হয়েছিল টেকনাফ সদর ইউনিয়নেরর নাজির পাড়া এলাকা এবং পিতার নামে ছিল ভুল। মৃত এজাহার মিয়া উল্লেখ ছিল পিতার নাম। যার সাথে মিল ছিল অপর এক ইয়াবা কারবারী এনামুল হকের পিতার নাম এবং ঠিকানাও ছিল এনামুল হকের বাড়ির ঠিকানা। সেই এনামুল হক এখন ১০২ ইয়াবা কারবারী হিসাবে আত্মসমর্পন করে কারাগারে রয়েছে।

এরপর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান একরামের বাড়িতে এসে পরিবারের সদস্যদের আশ্বস্থ্য করেছিলেন বলে জানান একরামের স্ত্রী। কথা বলেন মায়ের সাথে। কিন্তু একরাম হত্যার বিচারের আশ্বাস, আশ্বাসের মধ্যেই থেকেছে।

একরামের স্ত্রীর প্রশ্ন প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ফুল দিয়ে বরণ করা হলো, আর আমার নিরীহ স্বামীকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হলো কেন।
একরামের মা’র আকুতি
একরামের মা ষাটোর্ধ¦ হাফেজা খাতুন বলেন, একরামের দুই মেয়ের কষ্ট সহ্য হয়না। একরামের স্ত্রী কিইবা বয়স হয়েছে তার। অথচ এই বয়সে তাকে বিধবা করা হলো। কার কারণে মেয়েদুটো তাদের পিতাকে হারালো। তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, সারাক্ষন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন সন্তানের হত্যার যেন বিচার হয়। তার সন্তানের খুনীদের যাতে একই পরিণতি ভোগ করতে হয়। আল্লাহ যেন তা দেখান। একরাম হত্যার পেছনে কার হাত রয়েছে তা তিনি অনুমান করতে পেরেছেন বলে জানান।
ঘটনার কয়েকদিন পর একরামের ব্যবহারের চশমাটি দিয়ে যান এক লোক। যিনি চশমাটি কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাস্থলে পেয়েছিলেন। রক্তমাখা সেই চশমাটিই তাদের শেষ স্মৃতি। তবে ফিরে পাননি একরামের ব্যবহৃত মোবাইল দুটো। একরামের ব্যবহৃত শখের মোটর সাইকেলটিও মামলার আলামত হিসাবে থানায় জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানতে পারলেও তা উদ্ধার করতে পারেননি।

আরও খবর