মাদকবিরোধী অভিযানের ১ বছর : ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৩২৯ মাদক কারবারি

বিশেষ প্রতিবেদক :

ইয়াবা নামক মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষায় যুদ্ধ ঘোষণা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই অংশ হিসেবে গত ১ বছর ধরে চলা মাদকবিরোধী অভিযানে দেড় লাখের বেশি মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সময়ে র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ৩২৯ মাদক কারবারি।

টানা অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে ইয়াবার প্রধান রুট কক্সবাজারের টেকনাফের ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তবে আত্মগোপনে চলে যায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। ফলে ঠেকানো যায়নি ইয়াবার কারবার।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও হরদম চলছে ইয়াবা ব্যবসা। পাল্টে ফেলা হয়েছে ব্যবসার ধরনও। আগে টেকনাফ দিয়ে বেশিরভাগ ইয়াবা প্রবেশ করলে বর্তমানে সমুদ্রপথ ও উখিয়ার দুর্গম পাহাড়ি পথ বেছে নিয়েছে কারবারিরা। আর ইয়াবার চালান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আকাশপথ। ভাড়া করা হচ্ছে পাকস্থলী। বিক্রির ধরনেও আনা হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিভিন্ন অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। অনেক ব্যবসায়ী আবার শুধু পুরনো কাস্টমারের কাছে বিক্রি করছে ইয়াবা। ফলে তাদের ধরতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিনিয়ত রুট ও ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না ইয়াবা। এ ছাড়াও অনলাইনে ইয়াবা বিক্রির বিষয়টি অনেকটাই তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এই চক্রকে ঠেকাতে র‌্যাব-পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের একাধিক টিম কাজ করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সাইট ও ফেসবুক পেজ শনাক্ত করা হয়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে ইয়াবার।

র‌্যাব-পুলিশের করা তথ্য-উপাত্তের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ৪ মে থেকে শুরু হওয়া অভিযান জোরদার করা হয় ১৫ মে থেকে। এর মধ্যে র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে এক লাখের বেশি মাদক কারবারি। যার মধ্যে গত বছরের ৩ মে থেকে চলতি বছরের ১মে পর্যন্ত র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে ২৪ হাজার ৮৯৮ জনকে।

পুলিশ গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৮৮টি মাদক মামলায় যে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৯৫ জন মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে, তার বেশিরভাগই এই মাদক অভিযানের সময়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গত বছরের মে মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ১৪ হাজার ৩০৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়াও বিজিবি, কোস্ট গার্ডের হাতেও ধরা পড়ে কয়েক হাজার ইয়াবা কারবারি।গত বছরের ৩ মে থেকে চলতি বছরের ১ মে পর্যন্ত শুধু র‌্যাবই উদ্ধার করেছে ৬০৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য।

মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ১৫ মে থেকে চলতি বছরের ৯ মে পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৩২৯ মাদক কারবারি। এর মধ্যে ১০৯ জন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসে আছে। চাইলেই অল্প সময়ের মধ্যে থামানো যাবে না। তবে চলমান অভিযানের জেরে মাদকের বিস্তার রোধে অগ্রগতি হয়েছে।

বিশেষ অভিযানের মধ্যেও মাদকের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের জেলার উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত হয়ে এখনো দেশে ঢুকছে মাদক। বিশেষ করে কক্সবাজার-টেকনাফ সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই ধরা পড়ছে ইয়াবার ছোট-বড় চালান। এ ছাড়াও আকাশপথ ও পাকস্থলীতে করে ইয়াবা সরবরাহের চিত্র চোখে পড়ছে হরহামেশাই। চলতি বছরেই বিমানবন্দরে ৫টিরও বেশি ইয়াবার চালান ধরা পড়ায় বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। আর পাকস্থলী ভাড়াও যেন কৌশলের অংশ হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ পাকস্থলীতে ইয়াবা বহন করতে গিয়ে মৃত্যু হয় জুলহাস নামে এক যুবকের। গত ২৭ এপ্রিল তার লাশের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে পেটের মধ্যে ১১ প্যাকেটে ১৫০০ পিস ইয়াবা পান চিকিৎসকরা।

সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, এক বছর ধরে মাদকবিরোধী যে অভিযানটি চলছে সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এই অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের প্রভাবশালীদের সঙ্গে আঁতাত, অর্থের সঙ্গে আপস করার ঘটনা এ অভিযানকে কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যও মাদক কারবারিদের সহায়তা করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেরাও এই কারবারে যুক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে এ অভিযানে কার্যত সফলতা আসবে না। কারণ তারা টিকে থাকলে মাদক কারবারও টিকে থাকবে।

ওই সমাজ বিশ্লেষক আরো বলেন, আমাদের দেশে কোনো মাদক উৎপন্ন বা তৈরি হয় না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সরবরাহ থাকায় একটা চাহিদা তৈরি হয়েছে। ফলে মাদক সহজে থামবে না। মাদকের আগ্রাসন থামাতে সরবরাহ বন্ধের দিকে নজর দিতে হবে। সেটা না করে দেশের অভ্যন্তরে এ ধরনের অভিযান এক পক্ষীয় ভূমিকা পালন করবে।

বিজিবিসহ সব সংস্থার সমন্বয়ে আরো জোড়ালো অভিযান চালাতে হবে। পাশাপাশি যুব সমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখতে সচেতনতামূলক উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মাদক সমস্যা একদিনের নয়। কাজেই দুই-এক মাসের মধ্যে তা বন্ধও করা যাবে না। তবে অভিযানের কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মাদক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। যে কোনো পরিবেশে মাদকবিরোধী অভিযান চলমান থাকবে।

একই কথা বলেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা। তার মতে, মাদকের চাহিদা থাকায় এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে যতদিন পর্যন্ত অবস্থা স্বাভাবিক পর্যায়ে না আসবে ততদিন পর্যন্ত মাদকের বিরুদ্ধে চলা এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৪ মে এক সংবাদ সম্মেলনে মাদকের শিকড় উপড়ে ফেলার ঘোষণা দেন র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এ সময় তিনি আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের কথা জানান। মূলত র‌্যাবের ডিজির ঘোষণার পরদিন থেকেই সারা দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে।

আরও খবর