আবদুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন
টেকনাফ সদরের উত্তর লম্বরীপাড়ার বাসিন্দা মীর কাসেম প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মালিক। অল্প সময়েই অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। অথচ তার চালচলন এখনও একজন হতদরিদ্রের মতো। সবসময় ছেঁড়া লুঙ্গি আর শার্ট পরে চলাফেরা করেন। কিন্তু তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। জানা গেছে, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে মাদক পণ্য ইয়াবা ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন মীর কাসেম। তার মতো টেকনাফের বেশিরভাগ ইয়াবা ব্যবসায়ীর রয়েছে অঢেল সম্পত্তি। ইয়াবার বিরুদ্ধে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করলেও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের জৌলুশে কোনও কমতি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফ শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষের জীবনযাপন আলাদা। তাদের কোনও অভাব-অনটন নেই। তাদের অধিকাংশের রয়েছে অত্যাধুনিক ঘরবাড়ি। প্রতিটি বাড়ি তৈরি করতে খরচ হয়েছে কমপক্ষে কোটি টাকার মতো। অথচ, এক সময় তাদের কারও কারও একবেলা খাবারও জুটতো না। ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক ব্যবসা করে তারা আজ অঢেল সম্পদের মালিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশের মাদক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ গডফাদার টেকনাফের শীলবনিয়াপাড়ার বাসিন্দা সাইফুল করিম, তার ভাই জিয়াউল করিম ও রাশেদুল করিম একই গ্রুপের সদস্য। এরইমধ্যে রাশেদুল করিম ও মাহবুবুল করিমকে ইয়াবা ও অস্ত্রসহ গত সপ্তাহে গ্রেফতার করেছে টেকনাফ থানা পুলিশ। ১৫ বছর আগেও এই পরিবারের সদস্যরা একবেলা খেতে পারতেন না। আর এখন তারা কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। কক্সবাজার ও টেকনাফসহ পুরো দেশেই মাদকের রাজা হিসেবে পরিচিত সাইফুল করিম। গত বছরের মে মাস থেকে মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাইফুল করিম নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সূত্রের দাবি, সাইফুল কখনও মালয়েশিয়া, কখনও দুবাই আবার কখনও মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে অবস্থান করে দেশের ভেতরে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। সাইফুল করিম মাদক ব্যবসা করে ঢাকা, চটগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফে গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাট ও জমিসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। সাইফুলসহ তার পরিবার টেকনাফের ‘রাজা’ হিসেবে পরিচিত। টেকনাফের শীলবনিয়ায় তার যে অত্যাধুনিক বাড়িটি রয়েছে, তার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকার মতো। কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে আবাসিক হোটেলসহ কয়েকশ কোটি টাকার জমি রয়েছে তার। নামে- বেনামে তিনি এসব সম্পত্তি করেছেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
তালিকাভুক্ত আরেক ইয়াবা সম্রাট ও বদির আপন ছোট ভাই আব্দুস শুক্কুর, আব্দুল আমিন, ফয়সাল রহমান, বোন নুরজাহান ও ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। সম্প্রতি তারা সবাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেও বদির বোন নুরজাহান রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নাম প্রকাশ না করে এলাকাবাসী বলছেন— মূলত, সাবেক সংসদ সদস্য বদির ইন্ধনেই তারা মাদক ব্যবসা করে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, আত্মসমর্পণের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের অবৈধ লেনদেন ছিল। পুলিশকে নিয়মিত মোটা অংকের অর্থ দিয়ে এই মাদক ব্যবসায়ীরা টেকনাফে ইয়াবার চালান নিয়ে আসতেন। সবার নামে টেকনাফ ও কক্সবাজারে একাধিক মামলাও রয়েছে।
আরেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নুরুল হুদা— এক সময় ছিলেন গাড়ির হেলপার, আর এখন তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। আত্মসমর্পণের পর নুরুল হুদা বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছেন। জানা যায়, ২০১০ সালে তিনি শুরু করেন ইয়াবা পাচার। মাত্র আট বছর ইয়াবা বেচাকেনা করে বিপুল সম্পদের মালিকের হওয়ার পাশাপাশি হ্নীলা ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। তার রয়েছে একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও বিপুল পরিমাণ জমি। তার এই জৌলুশের উৎসও মাদক ইয়াবা। স্থানীয়দের দাবি, হুদাসহ তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় দুইশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
টেকনাফের নাজিরপাড়া এলাকার বাসিন্দা সম্প্রতি বন্দুকযুদ্ধে নিহত জিয়াউর রহমান ইয়াবা পাচার ও কেনাবেচা করে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। এলাকায় তার রয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের একটি আলিশান দোতলা বাড়ি। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে একাধিক ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে।
বর্তমানে জেলা কারাগারে অবস্থান করছেন আরেক ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পৌরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুশরাত। জালিয়াপাড়ায় তার রয়েছে একটি অত্যাধুনিক বাড়ি, টেকনাফে রয়েছে গাড়ির দুটি শো-রুম। ব্যাংকে জমা রয়েছে তার প্রায় ৫০ কোটি টাকার মতো। আরেক মাদক ব্যবসায়ী একরাম হোসেন ওরফে পিচ্চি একরাম কোরআনে হাফেজ। ২০১০ সালের দিকে ইয়াবা ব্যবসায় নাম লেখান তিনি। বর্তমানে মিয়ানমারে অবস্থান করে একরাম দেশে ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছেন। ইয়াবা কারবার করে মৌলভীপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
টেকনাফের মিঠাপানিরছড়া এলাকার শামসুল আলম ওরফে কানা শামসু এক সময় নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরে জীবন চালাতেন। গত ১০ বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসা করে এখন তিনি প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পদক আব্দুল্লাহর দুই ভাই জিয়াউর রহমান ও আব্দুর রহমান (দুজনই বর্তমানে জেলা কারাগারে) ইয়াবা ব্যবসা করে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। টেকনাফের হাতিয়ার ঘোনার জাকির হোসেন ইয়াবা ব্যবসা করে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। এলাকায় রয়েছে তার একটি অট্টালিকা। এছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে রয়েছে কয়েকটি ফ্ল্যাট। নিজে ২৮ লাখ টাকা দামের টয়োটা প্রিমিও গাড়িতে চলাফেরা করেন।
একই এলাকার কামাল হোসেন দীর্ঘদিন ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামানোর পর সৌদি আরবে পাড়ি জমান। বদির খালাতো ভাই মং মং সেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একাধিকবার ধরা পড়েছেন। আত্মসমর্পণের পর বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়ায় তার রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। একই এলাকার বাসিন্দা মুজিব ও সৈয়দ হোসেন ইয়াবা ব্যবসা করে অল্প সময়ে নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। স্থানীয় অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থাকলেও তাদের সহযোগীরা এখনও এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) টেকনাফের উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। তিনি ইয়াবা ব্যবসা করে প্রায় ৩ কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। এর মধ্যে টেকনাফে রয়েছে তার তিনটি বাড়ি। জাফর আহমেদের দুই ছেলে শাহজাহান ও দিদার মিয়ারও (বর্তমানে কারাগারে) রয়েছে অঢেল সম্পদ। তাছাড়া টেকনাফ পৌরসভার সাবেক মহিলা কাউন্সিলর কোহিনুর বেগমের স্বামী শাহ আলমের নামে ৪০ লাখ, আলী আহমদ চেয়ারম্যানের ছেলে আবদুর রহমানের (আত্মসমর্পণ করে জেলা কারাগারে) ৩০ লাখ, শামসুল আলমের নামে ৪০ লাখ, সাবেক মেম্বার বকতার আহমেদের নামে ৫০ লাখ, টেকনাফের নাজির পাড়ার এজাহার মিয়ার ছেলে নুরুল হক ভুট্টুর নামে ৬০ লাখ, নুরুল হোসাইনের নামে ৩০ লাখ, নাইট্যং পাড়ার মৃত আবদুল খালেকের ছেলে ইউনুসের নামে ৩০ লাখ, দক্ষিণ হ্নীলার ফকির চন্দ্র ধরের ছেলে নির্মল ধরের নামে ২০ লাখ ও টেকনাফের দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার বোরহান উদ্দিনের নামে ২০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি তাদের অবৈধ সম্পদের তালিকা করতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, বেশিরভাগ ইয়াবা ব্যবসায়ী অঢেল সম্পদের মালিক। তাদের সম্পদের খোঁজ নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রমজানের পরপরই দুদক ও এনবিআর এ ব্যাপারে জোরালো অভিযান চালাবে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-