বার্তা ২৪ :
গ্রাম্য একটা শ্লোক আছে, ‘সেই তো নথ খসালি, কেন লোক হাসালি’। সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট জোটের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিয়ে যে নাটকীয়তা, টানা-হেচড়া আর গুঞ্জন হল তাতে সেই শ্লোকটি ঘুরে আসছে রাজনীতির ময়দানে।
দফায় দফায় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচিত সদস্যদের শপথ ও তাদের নিয়ে নাটকীয়তার চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল সোমবার।
শপথ গ্রহণের সময়সীমা শেষের অন্তিম মুহূর্তে বিএনপির চারজন নির্বাচিত যখন সংসদের পথে তখন দলটির পল্টনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নিতে সরকার চাপ দিচ্ছে, জুলুম জবরদস্তি করছে।
কিন্তু মূল চমক দেখা যায় সন্ধ্যায় শপথ নেওয়ার পরই। শপথ নেওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশেই শপথ নিয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পর গুলশান কার্যালয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একই কথা বলেন। তিনি জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই বিএনপি থেকে নির্বাচিত চার নেতা শপথ নিয়েছেন।
তিনি তাহলে শপথ নিলেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সময় হলেই তা জানতে পারবেন।’
স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে অন্যরা তারেক রহমানের নির্দেশে শপথ নিতে গেল তাহলে ফখরুল গেলেন না কেনো? তাহলে তিনি কি তারেক রহমানের আদেশ মানতে চাইছেন না! নাকি অন্য কোনো রহস্য রয়েছে। বিএনপি কার নির্দেশে চলে এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই নানা রকম মুখরোচক আলোচনা রয়েছে। সেই আলোচনাকেই আবার উস্কে দিলো বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
আর সেটা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে পেছনের ঘটনায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট জোট থেকে ৮ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে জোটের নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবে না বলে জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত টেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত। ওইদিন ঐক্যফ্রন্ট থেকে ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচিত সদস্য সুলতান মনসুর (মৌলভীবাজার-২) জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেন। সুলতানের শপথ নেওয়ার পর থেকেই রাজনীতিতে নতুন গুঞ্জনের সূত্রপাত হয়। সেই গুঞ্জনকে আরো উষ্কে দেন সুলতান মনসুর নিজেই। তাকে বহিস্কার করে গণফোরাম। তিনি বলেন, ‘আমি তো শপথ নিয়েছি। অপেক্ষা করেন আরো আসবে।’
সুলতান মনুসরের সে ভবিষ্যতবাণীকে সত্য করে ২ এপ্রিল শপথ নেন গণফোরামের মোকাব্বির খান (সিলেট-২)। মোকাব্বির খান শপথ নিলে একদিকে গণফোরাম তাকে শোকজ করে, বহিস্কৃত হবেন বলে দলের নেতারা জানায়। অন্যদিকে দলের কাউন্সিলেই আবার তাকে ড. কামালের পাশের মঞ্চে বসতে দেখা যায়।
মোকাব্বির খানের শপথের পরই রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে যায়। রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ওঠে বিএনপি থেকে নির্বাচিতরাও শপথ নেবেন, বিনিময়ে দুর্নীতির দায়ে কারাবন্দি অসুস্থ চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত হবেন। সাংবাদিকরা যতই এই গুঞ্জন নিয়ে প্রশ্ন করেন; বিএনপি নেতারা বিষয়টিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেন। খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্ত হবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন দলের শীর্ষ নেতারা। সংসদ সদস্য হিসেবেও কেউ শপথ নেবেন না।
কিন্তু বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) শেষ সময়ে আচমকাই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান। বিএনপির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেবেন তারা গণদুশমন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য ও দলীয় প্রধানকে কারাগারে রেখে যারা শপথ নিচ্ছে তারা জনগণের থুথুর ঢলে ভেসে যাবে।’
দুই দিন পর ২৭ এপ্রিল রাতে বসে স্থায়ী কমিটির বৈঠক। তাতে স্কাইপির মাধ্যমে লন্ডন থেকে যোগদেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান। বৈঠক শেষে দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গের দায়ে জাহিদুরকে বহিস্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জাহিদুরের বহিস্কারের ঘটনায় যখন অন্যদের নিরুৎসাহিত হওয়ার কথা। কিন্তু না অন্যরাও শপথের প্রস্তুতি নিয়েই ঢাকায় ঘুরাঘুরি করতে থাকেন। অবশেষে ২৯ এপ্রিল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অনেক বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো স্পিকারের কক্ষে শপথ নেওয়ার জন্য হাজির হন হারুনুর রশীদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), আমিনুল ইসলাম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২), উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২) ও বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মোশাররফ হোসেন। তারা শপথ নেওয়া শেষেই ‘বোমা ফাটান’। জানান, তারেক রহমানের নির্দেশ পেয়েই শপথ নিতে এসেছেন।
অথচ দু’দিন আগেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল শপথ না নেওয়ার। কিন্তু দুই দিন পরেই তারেক রহমানের একক নির্দেশে দলীয় সে সিদ্ধান্ত পাল্টে গেল। স্থায়ী কমিটির কোনো বৈঠকও হল না। এমনকি যার খবর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভীও জানেন না।
আরও নানান রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা কয়েকদিন ধরেই বিএনপি বলা বলি করছিলো শপথ নিতে সরকারের চাপ রয়েছে। বিশেষ করে জাহিদুর রহমানের শপথের পর তারা আরও গলা ফাটিয়ে বলতে থাকেন। রুহুল কবীর রিজভী ছিলেন কয়েকধাপ এগিয়ে। এখন বলা হচ্ছে তারেক রহমানের নির্দেশেই শপথ। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এতোদিনের বক্তব্য কি স্ট্যান্ডবাজি, নাকি অন্যকিছু। অন্যকিছু যদি নাই হয় তাহলে তারেক রহমান বলার পরেও কার নির্দেশে এখনো শপথ নিলেন না মির্জা ফখরুল।
তৃণমূলের নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের নির্দেশে শপথ নিয়ে থাকলে ভালো। আর যদি না হয় তাহলে খবর আছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-