মির্জা মেহেদী তমাল :
টেকনাফ উপকূলীয় এলাকা থেকে ৯২ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে নারী ৪৬, পুরুষ ২৬ ও ২০ জন শিশু। উদ্ধার হওয়া নারীদের বয়স ১৩ থেকে ২২-এর মধ্যে।
এরা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপকূলে আশ্রয়শিবির ছেড়ে পালাচ্ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি। তবে সম্প্রতি আশ্রয়শিবির থেকে পালানোর সময় আটক রোহিঙ্গার অধিকাংশই নারী।
আটক নারীর অনেকেই জানিয়েছেন, বিয়ে করে সংসার পাতার আশায় তারা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চিন্তা করেছিলেন। সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সঙ্গে অনেকেরই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাওয়ার খরচ বহন করছেন ওই যুবকরাই। আবার অনেকেই বিয়ের প্রলোভনে রোহিঙ্গা শিবির ছাড়ছেন। আটক এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে টেকনাফ থানা পুলিশ জানিয়েছে।
উদ্ধার হওয়া নারীদের একজন উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের সুফিয়া বেগম (২০)। তিনি জানান, তাদের মিয়ানমারের রাখাইনের বাড়িতে ছিল মাছের খামার। সংসারে আয়-রোজগারও ছিল ভালো। সেই ঘরবাড়ি রেখে এখন ঠাঁই হয়েছে উখিয়ায় পাহাড়ের ঝুপড়ি ঘরে। বিভিন্ন এনজিওর দেওয়া ত্রাণে চলছে পরিবার।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে বয়সটাও বাড়ছে। বিয়ে তো করতে হবে। অনেক ভেবে করে পরিবারের সিদ্ধান্তে মালয়েশিয়া যাওয়ার চিন্তা করি।’ এই নারী জানান, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত এক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ওই ছেলের পরিবারও কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে বাস করে। কিন্তু বিজিবির হাতে ধরা পড়ায় আপাতত বিয়ের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না তার। উদ্ধার হওয়া কয়েকজন নারী জানিয়েছেন, এখানে শিবিরে বিয়ে করতে চাইলে বরপক্ষকে বড় অঙ্কের নগদ টাকা দিতে হচ্ছে। বেশির ভাগ পরিবারের সেই সামর্থ্য নেই। সে তুলনায় মালয়েশিয়ায় বিয়ের বাজারে রোহিঙ্গা নারীদের চাহিদা রয়েছে।
কারণ সে দেশের শ্রমবাজারের একটি অংশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা যুবকদের দখলে। রোহিঙ্গা পুরুষের তুলনায় সেখানে রয়েছে রোহিঙ্গা নারীর অভাব। টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের একাধিক দলনেতা (মাঝি) জানিয়েছেন, কিছু সহজ-সরল রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে দালাল চক্রের সদস্যরা শিবির থেকে বের করছেন। তারা বলেন, অধিকাংশ নারী বিয়ের আশায় মালয়েশিয়া যাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। দালালদের এখন মূল টার্গেট অবিবাহিত নারী।
পুলিশ জানিয়েছে, অবিবাহিত নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার যেসব নারীর স্বামী মালয়েশিয়ায় তারাও যে কোনোভাবে মালয়েশিয়া যেতে উন্মুখ। আরাকানে (রাখাইনে) যাদের অবস্থা সচ্ছল ছিল সেসব পরিবার যে কোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মালয়েশিয়া যেতে তৎপর। অনেক তরুণী ও কম বয়সে বিধবা নারীই মালয়েশিয়া যেতে প্রতিনিয়তই চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন।
সূত্র জানান, মালয়েশিয়া যেতে রাজি হওয়াদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা ‘টোকেন মানি’ আদায় করা হয়। চুক্তি হয় মালয়েশিয়া পৌঁছে গেলে বাকি টাকা দেওয়ার। ক্যাম্পের দালালদের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে রয়েছে সুযোগসন্ধানী বাংলাদেশি দালালও। রাজি হওয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের করে তাদের (বাংলাদেশি দালালদের) হাতে তুলে দেওয়া হয়। আর বাংলাদেশি দালালরা সুযোগ বুঝে ট্রলার বা নৌকায় সাগরে অবস্থান করা জাহাজে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। ক্ষেত্রবিশেষ তারা ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রে যাত্রা সফল হয়।
তবে সাম্প্রতিককালে কেউ মালয়েশিয়া যেতে পেরেছেন, এমন কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। ভয়ঙ্কর এই যাত্রায় অধিকাংশ মানুষেরই সাগরে করুণ মৃত্যু ঘটে। এর পরও নানা প্রলোভনে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে অজানার পথে যাত্রা করিয়ে দেয় দালালরা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-