তাপপ্রবাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

ড. মোহন কুমার দাশ

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে খুবই বিপজ্জনক হলো তাপপ্রবাহ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্বব্যাপী মারাত্মক তাপপ্রবাহের ঘটনা বেড়ে যাওয়া। গবেষণার প্রাপ্ত ফল থেকে জানা যায়, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রতি চারজনের তিনজন তাপ ও আর্দ্রতাজনিত মারাত্মক তাপপ্রবাহের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। এ ঝুঁকির বেশিরভাগই মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাপপ্রবাহ বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। ক্লাইমেট মডেল প্রজেকশন দেখাচ্ছে, পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থল ও জলভাগে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। আগামীতে উষ্ণতম দিন ও রাতের সময়সীমা ও সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বিগত পঞ্চাশ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণে দেখা যায়, এ ধরনের তাপপ্রবাহের ঘটনা ঘন ঘন হচ্ছে।

ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তাপপ্রবাহ স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকির পাশাপাশি জ্বালানি, পানি, পরিবহন, পর্যটন খাতেও ঝুঁকি তৈরি করছে। 

তাপপ্রবাহ এবং এর প্রভাব নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর সিরিজ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছিল সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (এসএমআরসি)। ডিসেম্বর ২০১৫ সালে গবেষণা কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ গবেষণার চরম ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে ষাটের দশকে এবং সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে দেশব্যাপী তাপপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। তাপপ্রবাহের ফলে হিটস্ট্রেস, ডায়রিয়া, কলেরা, ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক, কার্ডিওভাসকুলার ও রেসপিরেটরি সম্পর্কিত সমস্যা ঘটতে থাকে।

এসবের কারণে মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে। আমাদের দেশে গরমের সময় ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। এ সময় খাবার তাড়াতাড়ি দূষিত হয় এবং ডায়রিয়ার জীবাণু ইকোলাই ব্যাকটেরিয়া সহজে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বংশবৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। এ সময় হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। মানসিক অবসাদ, মুড ডিসঅর্ডারের সমস্যা তৈরি হয় তাপপ্রবাহের তীব্রতা বাড়তে থাকলে। আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাবে শিশু ও প্রবীণ সদস্যরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পরপর দু-তিন দিন ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেশি হলে তাপপ্রবাহ চলমান ধরা হয়। যদি তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেশি হয়, তাহলে তীব্র তাপপ্রবাহ। ১৯৮০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের তাপমাত্রা রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৯৮৬ ও ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছিল কয়েক দিন।

২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে বেশ কিছুদিন তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। ঢাকাতে সর্বোচ্চ ৩৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড ছিল ২৪ এপ্রিল ২০১৪ সালে। বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে তাপপ্রবাহের অবস্থা বিরাজ করে।

তাপপ্রবাহ নিয়ে প্রাক-মৌসুম (মার্চ, এপ্রিল ও মে) এবং মৌসুম (জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) ঋতুতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষ ও পরিবেশ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সহায়তা করবে। 

লেখক: ড. মোহন কুমার দাশ

সিনিয়র গবেষক, ক্লাইমেট মডেল অ্যান্ড সিমুলেশন-ল্যাব, পানি এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, বুয়েট, ঢাকা।

আরও খবর