পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারা রাসুল (সা.) এর শহর। সে শহরের সবুজ গম্বুজের নিচে তার রওজা মোবারক। আর সে শহরে ‘কোরআন মরূদ্যান’ নির্মাণের দীর্ঘ দিনের লক্ষ্য সৌদি কর্তৃপক্ষের। সে উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে সারা বিশ্বের স্থাপত্য সংস্থাগুলোর কাছে উদ্যানের নকশা চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অসংখ্য নকশা থেকে স্প্যানিশ স্থপতি রিকার্ডো বফিলের প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করে সৌদি আরব। কোরআন ও ইসলামী ইতিহাসের মহাকাব্যিক উপস্থাপনই হবে এ মরূদ্যানের মূল লক্ষ্য।
সৌদির পর্যটন ও জাতীয় ঐতিহ্য পরিষদের মহাপরিচালক অধ্যাপক সুলতান বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোরআন মরূদ্যান প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে অনুমোদনও দিয়েছেন। এ প্রকল্পের চুক্তিতে কোরআন মরূদ্যান তৈরির জন্য ভূমি বরাদ্দ, মদিনা শহর উন্নয়নে সমঝোতা ও ইসলাম প্রচার বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রকল্পটিতে অভ্যর্থনা হল, অনেকগুলো প্রদর্শনী হল ও জাদুঘরের কিছু প্রদর্শনী হল থাকবে। পাশাপাশি একটি বৃহৎ লাইব্রেরি ও বক্তৃতা হল, ব্যবস্থাপনা সুবিধা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্নির্মাণ ল্যাবরেটরিজ, গুদাম, একটি প্রধান মসজিদ, বাগান, পুষ্পবীথি, সারি সারি খেজুরগাছ ও জলাধারে ঘেরা বৃত্তাকার আঙিনায় ঋদ্ধ এই মরূদ্যান অনন্য হয়ে উঠবে।
অতিথি ও অভ্যর্থনা হল
কোরআন যেসব স্থানে অবতীর্ণ হয়েছে সেসব স্থানের প্রাকৃতিক, সামাজিক ও সভ্যতা-সংস্কৃতিকেন্দ্রিক মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শনগুলো এই হলটিতে তুলে ধরা হবে। সাধারণভাবে আরব উপদ্বীপ, বিশেষ করে হিজাজ ও মক্কার বৈশিষ্ট্যগুলো মূর্ত হবে।
মহানবী (সা.)-এর জন্ম, বেড়ে ওঠা, কোরআন অবতীর্ণ হওয়া, এ ক্ষেত্রে কুরাইশদের অবস্থান, প্রথম ব্যক্তির ঈমান আনয়ন, রাসুল (সা.)-এর ওপর কিভাবে কোরআন অবতীর্ণ হতো, মক্কা-মদিনায় কোরআনের যে অংশটুকু অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেগুলোর ‘শানে নুজুল’ (কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণ) ইত্যাদিও এই হলে প্রদর্শিত হবে।
কোরআনের পঠন পদ্ধতির যুগবিন্যাস
এই হলটিতে কোরআন পাঠ ও তারতিলের বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকবে। রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে খুলাফায়ে রাশেদার যুগ এবং তাঁদের পর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ইসলামী যুগের বিখ্যাত কারি ও তাঁদের কিরাতের ধরন, এরপর আধুনিক যুগের কারি ও অন্যান্য বিরল কিরাত ও শ্রবণের ধরন, মুসলিম বিশ্বের কিরাতের বৈচিত্র্য, মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর কারিদের পঠন-সুরের রকমারিত্ব এবং হাফেজদের গুরুত্ব ও সম্মান, মক্তব শিক্ষা ও শিশু কোরআন শিক্ষালয় ইত্যাদি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা হবে।
যুগপরিক্রমায় কোরআন প্রকাশনা হল
কোরআন প্রকাশনার ইতিহাস, রাসুল (সা.)-এর যুগে কোরআন সংকলন, গাছের পাতা ও বুক-স্মৃতিতে সংরক্ষণ, এরপর কোরআন সংকলনে বিভিন্ন পর্যায়ে নিরীক্ষণ, পাথরের টুকরা থেকে পশুর চামড়ায় রূপান্তর, কোরআনের বিভিন্ন ধরনের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ, পরবর্তী সময়ে কালের পরিক্রমায় মদিনা ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে গড়ে ওঠে কোরআন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও কোরআন প্রকাশনা বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমের চমৎকার আয়োজন থাকবে এই হলে।
কোরআন-গল্প হল
এই হলে অডিও-ভিডিওর মাধ্যমে কোরআনের নির্দিষ্ট ১২টি গল্প চিত্রায়িত হবে। কোরআনে বর্ণিত ভূমিচিত্র, ঘটনা ও ইতিহাসঘনিষ্ঠ রেখা-মানচিত্র প্রদর্শন করা হবে।
কোরআনের জ্ঞান-বিজ্ঞান হল
কোরআন-সংক্রান্ত বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রদর্শনী হবে এতে। তাফসির, তাজভিদ, কিরাত-বৈচিত্র্য, নাসেখ-মানসুখ, ইসলামী ফিকহশাস্ত্র, তাওহিদশাস্ত্র এবং ইসলামী আইন ও ভাষাবিদ্যাসহ অন্য বিষয় এখানে উপস্থাপিত হবে।
কোরআন ও মুসলিম আর্টস হল
কোরআন, বিভিন্ন চিত্র ও শিল্পকর্মে কোরআনের ব্যবহার, মসজিদ-মাদরাসা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, টাওয়ার ও অন্যান্য স্থাপনায় কোরআনের আয়াতের ব্যবহারকর্ম এখানে প্রদর্শন করা হবে।
পাথর, সিরামিক, গ্লাস, ধাতু, কাচ, চামড়া, জেলিন, টেক্সটাইল, কার্পেট, কাবার গিলাফের টুকরা ও মসজিদে নববীর পর্দার ওপর অঙ্কিত কোরআনের আলংকারিক আয়াতগুলো ব্যবহারের মূল চিত্র এখানে প্রদর্শন করা হবে।
শিশুদের হল
কোরআন মরূদ্যান কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য কোরআন বিষয়ক বিভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য, কর্মপন্থা, রীতি-সংস্কৃতি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা রেখেছে। এখানে অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের কাছে ইসলামের ইতিহাস ও নিত্যনতুন ইসলামকেন্দ্রিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে।
জাদুঘর ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র
কোরআন মরূদ্যানে ইসলামী সংস্কৃতি-সভ্যতার জাদুঘরও গড়ে তোলা হবে। এ জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রিন্স সুলতান বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ। এ ছাড়া কোরআনের তাৎপর্য এবং কোরআনের উদ্ভাবনী বিষয়গুলো এখানে ফুটিয়ে তোলা হবে। সন্নিবেশ করা হবে কোরআনের শত-সহস্র সংরক্ষিত কপি। মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই মরূদ্যান ও পামগাছের বন রয়েছে। তাই এ অঞ্চলেই কোরআন মরূদ্যানটি স্থাপন করতে চায় সৌদি আরব। দুই লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত মরূদ্যানটি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ বিমানবন্দরের কাছে অবস্থিত।
বিপুল এলাকা নিয়ে নির্মিতব্য এ মরূদ্যানের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ইসলামী স্থাপত্যে এটি অন্য সব স্থাপনাকে ছাড়িয়ে যাবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-