নুসরাত হত্যার নেপথ্যে ভয়ঙ্কর কারণ

অনলাইন ডেস্ক – কেন হত্যা করা হয়েছে নুসরাত জাহান রাফিকে? আর হত্যার জন্য আগুনই বা কেন বেঁচে নেয়া হলো, এই প্রশ্নগুলো এখন সামনে চলে  এসেছে সঙ্গত কারণেই। যে মেয়েটা পরীক্ষার হলে গিয়েছিলো স্বপ্ন নিয়ে, তাকে কেন আগুনে পুড়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হলো, জানতে চেয়ে দেশের নানা প্রান্তের মানুষেরা গত দুই দিন ধরে মানববন্ধন সহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে। কিন্তু এর পেছনে যে কত ভঙ্কর সত্য লুকিয়ে রয়েছে, তা জানলে শরীর শিউরে উঠবে।

নুসরাতের শ্লীলতাহানির অভিযোগে করা মামলায় ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার মুক্তির দাবিতে ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে কমিটি গঠন করা হয়। ২০ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক হন শাহাদাত হোসেন শামীম।

তাদের নেতৃত্বে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে গত ২৮ ও ৩০ মার্চ উপজেলা সদরে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।

এরপর ৪ এপ্রিল বিভিন্ন জায়গায় স্মারকলিপি দেয়া হয়। ওই দিনই নুর উদ্দিন, শাহাদাত ফেনী কারাগারে সিরাজ উদদৌলার সাথে দেখা করে তার কাছ থেকে নুসরাতকে হত্যার আদেশ পান। পরদিন ৫ এপ্রিল বৈঠক করে তাকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেন নুর ও শাহাদাত। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া হয়।

এই হত্যার তদন্তকারী সংস্থা বলছে, দুটি কারণে নুসরাতকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথমত, শ্লীলতাহানির মামলা করে অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করিয়ে নুসরাত শিক্ষক সমাজকে ‘হেয়’ করেছেন। দুই. আসামি শাহাদাত নুসরাতকে বারবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু নুসরাত তা গ্রহণ না করায় শাহাদাতও হত্যার পরিকল্পনা করেন।

শনিবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে এই দাবি করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডির পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে এই ব্রিফিংয়ে পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ৫ এপ্রিল নুর, শাহাদাত, জাবেদ হোসেনসহ নুসরাত হত্যা মামলার কয়েক আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার পশ্চিম ছাত্রাবাসে বৈঠক করে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তদন্তের কারণে কয়েকজনের নাম এখনই বলা হবে না বলে জানান তিনি।

বৈঠক করে নুর, শাহাদাতেরা নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আরও পাঁচজনের সাথে আলোচনা করেন। এঁরা সবাই সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী—এ কথা জানিয়ে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এই পাঁচজনের মধ্যে দুজন মেয়ে ও তিনজন ছেলে ছিলেন। এই দুজন মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে কেরোসিন ও তিনটি বোরকা পলিথিন ব্যাগের মধ্যে করে নিয়ে আসেন।

৬ এপ্রিল সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের ভেতরে সাইক্লোন শেল্টার ভবনে ক্লাস হয়। ক্লাস শেষে সেখানে শাহাদাতের কাছে কেরোসিন ও বোরকা দেন ওই মেয়েটি। ওই জায়গায় আরও দুজন ছিলেন। ওই মেয়েসহ সবাই সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলার ছাদে দুটি টয়লেটে লুকিয়ে থাকেন। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে ওই ভবন পুরোপুরি খালি ছিল। পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ আগে ওই পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে থাকা আরেকটি মেয়ে চম্পা (কেউ কেউ শম্পাও উচ্চারণ করেন) হলে ঢোকার সময় নুসরাতকে বলেন যে তার বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে। এ কথা শুনে নুসরাত তৃতীয় তলার ছাদে চলে যান। সেখানেই ওড়না দিয়ে বেঁধে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য নুরসহ আরেকটি দল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার গেটে অবস্থান করছিল জানিয়ে ব্রিফিংয়ে পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, নুর, হাফেজ আবদুল কাদেরসহ পাঁচজন গেট পাহারা দিচ্ছিলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে মাদ্রাসার বাইরে লোকজনের মধ্যে বোরকা পরে বের হয়ে যান শাহাদাতসহ অন্যরা।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ আটজন গ্রেপ্তার রয়েছেন। বাকি আরও অনেকের নাম উঠে আসতে পারে। তবে পরিকল্পনাকারীরা ২০১৬ সালে নুসরাতের চোখে চুন মেরেছিল। তখন মেয়েটির হাসপাতালে চিকিৎসা হয়। এরপর ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নুসরাতকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। সেসব ঘটনা তারা সামাল দিয়েছিল। এবারও তাই নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পর পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেন নুর, শাহাদাতেরা।

আরও খবর