মির্জা মেহেদী তমাল, বিডি প্রতিদিন :
আলাদিনের চেরাগ! ঘষা দিলেই বেরিয়ে আসে বিশাল এক দৈত্য। বেরিয়েই বলে, ‘হুকুম করুন মালিক’। চেরাগের মালিক দৈত্যকে তার পছন্দের জিনিসের কথা বলে। মুহূর্তে সেই দৈত্য মালিকের পছন্দের জিনিস সামনে হাজির করে দেয়। রূপকথার এ গল্পটি মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
কিন্তু রূপকথার এ গল্পকে বাস্তব রূপ দিয়েছে টেকনাফের কিছু মানুষ। বাস্তবে রূপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেরাগের নাম বদলে হয়েছে ‘ইয়াবা চেরাগ’। আর এ ইয়াবা চেরাগের ছোঁয়ায় রাস্তার ফকির হয়েছে রাজা-বাদশাহ। একটা সময় এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যেন আলাদিনের চেরাগের সেই দৈত্যকেও হার মানিয়ে দেয় ‘ইয়াবা চেরাগ’।
অল্প দিনেই টেকনাফের ফকির, হকার, ঠেলাচালক, দোকান কর্মচারী ফুলে ফেঁপে কলাগাছে পরিণত হতে থাকে। নিজের দেশে প্রাসাদোপম অট্টালিকা, তারকা হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। তারও পরে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের ধনী দেশগুলোয় পাড়ি জমায় তারা। মধ্যপ্রাচ্যে দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পাশ্চাত্যে বাসাবাড়ি গড়ে তোলে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংসকারী মরণ নেশা ডার্টি পিল খ্যাত ইয়াবা বেচে এই কারবারিরা হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যায়।
কক্সবাজারের টেকনাফে সরেজমিন জানা গেছে ইয়াবা কারবারিদের অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার নানা গল্প। টেকনাফেই রয়েছে শতাধিক অট্টালিকা; যার সবই ইয়াবা কারবারিদের। গত ফেব্রুয়ারিতে ১০২ কারবারির আত্মসমর্পণের পর পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা তাদের সম্পদের খোঁজ নিতে গিয়ে হতবাক। তারা বলছেন, এও কি সম্ভব!
কক্সবাজারের টেকনাফে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফে কেউ অর্থ লগ্নি করেছেন, আবার কেউ অর্থ লগ্নি ছাড়াই কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
তিনি বলেন, টেকনাফ-উখিয়ার সাবেক এমপির বেয়াই আকতার কামাল ছিলেন ইয়াবা সাম্রাজ্যের একজন গডফাদার। এমপির বেয়াই হওয়ার সুবাদে তার ছিল প্রচ দাপট। যেসব ইয়াবার কারবারি এমপির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পারতেন না, তারা এই আকতার কামালকে দিয়েই কাজ করাতেন। এমনই একজন ইয়াবা কারবারির একটি বড় চালান ঢুকবে টেকনাফে। নৌকায় করে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে আসার কথা সেই চালান। সেই ব্যবসায়ী যোগাযোগ করেন আকতার কামালের সঙ্গে। কারণ, তাদের অজান্তে এক পিস ইয়াবাও দেশে প্রবেশ করানো সম্ভব নয়।
সেই ব্যবসায়ী আকতার কামালকে বলেন, ১০ লাখ পিস ইয়াবার চালান আসবে। তিনি যেন বিষয়টি দেখভাল করেন। আকতার কামাল বলেন, ‘আচ্ছা, যাও। ব্যবস্থা করছি। এখন আমার দায়িত্ব। আমি খবর দিলে চালান আমার কাছ থেকে বুঝে নিও।’ নির্ধারিত দিনে আসে সেই চালান। আকতার কামাল আগেভাগেই যাকে যেখানে প্রয়োজন, সেই পরিমাণ টাকা দিয়ে লাইন ক্লিয়ার করে রাখেন। চালানটি নদ ও সাগর থেকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় আকতার কামালের বাসায়। পরে খবর দেওয়া হয় সেই কারবারিকে। কারবারি আসার পর আকতার কামাল বলেন, ‘তোমার চালান নিয়ে যাও। প্রতি পিসে ৩ টাকা করে কমিশনে যা আসে, তা দিয়ে মাল নিয়ে যাও।’ ওই ব্যবসায়ী প্রতি পিসে ৩ টাকা করে হিসাবে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে সেই চালান নিয়ে যান। এটা এক দিনের হিসাব। মাসে এমন অসংখ্য চালান ছাড়ের কাজ করেই কমিশন নিতেন আকতার কামাল। কমিশনেই শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি।
কিন্তু গত বছর ২৫ মে তার গুলিবিদ্ধ লাশ মেলে হিমছড়ি এলাকায়। সরেজমিন জানা যায়, ‘নাম্বার ওয়ান’ ইয়াবা কারবারি বলা হয় হাজী সাইফুল করিমকে। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে হয়েছেন ব্যবসা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি)। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বিস্তৃত তার ব্যবসা। পুুলিশের সঙ্গে রয়েছে তার যৌথ বাণিজ্য। কক্সবাজারের সাগরপাড়ে গড়ে তুলেছেন ইকো রিসোর্ট। টেকনাফের বাসিন্দা হলেও বাস চট্টগ্রামে। ‘এস কে ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তিনি। গার্মেন্ট, আমদানি-রপ্তানি, রিসোর্টের ব্যবসা রয়েছে তার। চট্টগ্রাম শহরের কাজীর দেউড়ি ভিআইপি টাওয়ারে রয়েছে তার একাধিক অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট। কক্সবাজারের কলাতলী পয়েন্টে হোটেলও নির্মাণ করছেন। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে সিআইপি শিল্পপতি সাইফুল এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি কিনেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে তার এই ফুলে ফেঁপে ওঠার আলাদিনের চেরাগের নাম ইয়াবা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় দেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবার ডিলার এই সাইফুল করিম। টেকনাফের নাইটংপাড়ার বাসিন্দা আবদুল গফুরের পুত্র মেহেদী হাসান ওরফে মেহেদী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। ইয়াবার বিনিময়ে নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চোরাই গাড়ি এনে গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
টেকনাফের ইয়াবার জগতের কিং মেহেদী হাসান এখন ১০-১২টি যানবাহন ছাড়াও অঢেল সম্পদের মালিক। ইয়াবা ও চোরাই গাড়ির ব্যবসা করে মেহেদী টেকনাফ পৌরসভাসহ বিভিন্ন জায়গায় তার নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।
টেকনাফে রিকশার টায়ার রিপেয়ারিং করতেন শফিক। বর্তমানে টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম রয়েছে তার। মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেই বীরদর্পে প্রকাশ্যে ঘুরছেন শফিক। অঢেল সম্পদের মালিক শফিকের বাবার নাম আবদুল গফুর। পেশায় রিকশার মিস্ত্রি। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, সম্ভাব্য স্থানে খুঁজেও শফিককে পাওয়া যায়নি। তবে শফিককে গ্রেফতারে তৎপর রয়েছে প্রশাসন। এই শফিকের রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
অনুসন্ধানে বেশকিছু তথ্য মিলেছে। তিনি দুবাইয়ে ব্যবসা করছেন। দোকান কিনে মোবাইলের ব্যবসা তার জমজমাট। টেকনাফ সদর ইউনিয়ন, পৌরসভা, মেরিন ড্রাইভ এলাকায় কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি তার রয়েছে। অনুসন্ধানে পাওয়া সূত্রমতে, সদর ইউনিয়নের পূর্ব ডেইলপাড়া মসজিদের সামনে দোতলা ভবন, সেমিপাকা বাড়িসহ তিনটি জমি, ইয়াবা কারবারি ফজলের বাড়ির সামনে তিন তলা ভবন, পশ্চিম ডেইলপাড়া হাফেজ উল্লাহর বাড়িসংলগ্ন বিশাল মার্কেটসহ ভাড়া বাসা, আদিল মাস্টারের বাড়িসংলগ্ন প্রাচীরঘেরা আরও একটি জমি, শাহ আলমের বাড়ির পেছনে আলিশান কটেজ। মূলত ওই কটেজে বসে নিয়ন্ত্রণ করেন ইয়াবাসহ তার অপরাধ সাম্রাজ্য।
২০০৭ সালেও দিনমজুর ছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফের নাজিরপাড়ার সহোদর নুরুল হক ওরফে ভুট্টো (৩২) ও নুর মোহাম্মদ (৩৫)। মাঠের কাজ না থাকলে জীবিকার তাগিদে মাঝেমধ্যেই রিকশা চালাতেন দুই ভাই। অভাবের সংসারে তাদের বৃদ্ধ বাবা এজাহার মিয়ারও (৬৭) বসে থাকার উপায় ছিল না। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনিও মাঝেমধ্যে রিকশার প্যাডেল ঘোরাতেন। তবে ২০০৯ সালে হঠাৎ করেই ভুট্টো দেখা পান ‘আলাদিনের চেরাগের’। মরণ নেশা ‘ইয়াবা’ বড়ির ব্যবসা করে রীতিমতো আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয় ভুট্টোর পরিবারের। ফুলে ফেঁপে পাহাড়সম হতে থাকে সম্পত্তি। যদিও এ ইয়াবার কারণেই আজ নিঃস্ব হতে চলেছেন ভুট্টোরা।
মানি লন্ডারিং ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুসারে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি গত ২২ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে (বিশেষ জজ) তাদের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার আবেদন জানিয়েছে। নতুন মাদক আইন কার্যকর হওয়ার পর এটাই প্রথমবারের মতো কোনো মাদক ব্যবসায়ীর সম্পত্তি ক্রোকের আবেদন। এটা গৃহীত হলে সব ইয়াবা ব্যবসায়ীর সম্পদ জব্দ হতে পারে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-