কক্সবাজারে খনিজ সম্পদে হাজার কোটি টাকার বাজার

ডেস্ক রিপোর্ট – খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর সম্ভাবনাময় একটি দেশ। মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও বর্তমানে এখানে পাওয়া যাচ্ছে উন্নতমানের কয়লা। তবে এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে বেশকিছু সম্ভাবনাময় কিন্তু অপ্রচলিত খনিজ পদার্থের উৎসস্থল আছে। নতুনভাবে আরও খনিজ সম্পদের উৎসস্থল সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে দেশেই এই সব খনিজ পদার্থের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি করা সম্ভব। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে রপ্তানি করা হলে এসব খনিজ পদার্থ থেকেই সরকার বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের (বিএইসি) সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার সদরের নাজিরটেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রসৈকতের বালিতে ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি দামের অন্তত ১৭ লাখ ৪০ হাজার টন খনিজ পদার্থ মজুদ রয়েছে। সৈকতের বালিতে মোট খনিজের প্রাক্কলিত মজুদের পরিমাণ ৪৪ লাখ (৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন) টন। আর প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন (এক দশমিক ৭৫ মিলিয়ন)। বিশ্ববাজারে উচ্চ চাহিদার মজুদ আকরিক রপ্তানি করতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মূল্যবান খনিজ বালি জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গারনেট ও রুটাইল উত্তোলন করা যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি টন জিরকনের দাম ৬০ হাজার টাকা আর বাকি খনিজগুলোর দাম প্রতি টন গড়ে ৬ হাজার টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমদ বলেন, চাহিদা থাকায় দেশে চুনাপাথরের ভালো ব্যবহার হচ্ছে। নুড়িও ব্যবহৃত হচ্ছে। জিরকন বাজারজাতকরণের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সমুদ্রসৈকত থেকে এটি আহরণ করা হলে পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অপ্রচলিত এই খনিজ সম্পদগুলো থেকে দেশে ও দেশের বাইরে ভালো বাজার তৈরি করা সম্ভব। তবে এর আগে দেশে এ ধরনের কী পরিমাণ খনিজ সম্পদ আছে তার হিসাব বের করতে হবে নীতিনির্ধারকদের। এরপর পরিবেশের ওপর এর কোনো প্রভাব আছে কি না তা দেখে বাণিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। অস্ট্রেলিয়া সরকার কক্সবাজারের খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। আর দেশটির গভীর আগ্রহের কথা জানার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখভালের জন্য ৯ সদস্যের কমিটিও গঠন করেছে। প্রিমিয়ার মিনারেলস নামের একটি অস্ট্রেলীয় কোম্পানি ব্যয়বহুল জিরকন উত্তোলনের জন্য প্রাথমিকভাবে ৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে। ১৯৬০ সালে কক্সবাজারে এই খনিজ সম্পদের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায়। পরে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন এটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। সমুদ্রের বেলাভূমি থেকে খনিজ সম্পদ পৃথক করে তা আহরণের জন্য ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকারের সহায়তায় কক্সবাজারে একটি পাইলট প্লান্ট স্থাপন করা হয়। বিএইসির বিজ্ঞানীরাও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অপর একটি প্লান্ট স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে। কিন্তু এখনো এর কোনো অগ্রগতি নেই।

কক্সবাজার সি বিচ এক্সপ্লয়টেশন সেন্টারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সমুদ্রসৈকত থেকে পরীক্ষামূলকভাবে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থার কাছে ক্ষুদ্র পরিসরে তা বিক্রি করা হচ্ছে। কক্সবাজারের এক্সপ্লয়টেশন সেন্টারের গবেষণামতে, কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে খনিজ পদার্থসমৃদ্ধ বালুর ১৭টি পয়েন্ট আছে। এসব পয়েন্টের বালুতে মোট আটটি খনিজ পদার্থ আছে, যার একটি জিরকন। সাধারণত রাসায়নিক বিকিরণের উপাদান হিসেবে জিরকন ব্যবহৃত হয়। আর অপর পদার্থ মোনাজাইট থেকে যে সেরিয়াম পাওয়া যায়, তা কালার টেলিভিশনের পিকচার টিউব ক্যাথডেওর ও ক্যামেরার লেন্সের কোটিংয়ে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের খনিজ পরমাণু প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান ও বিশ্ববাজারের চাহিদাসম্পন্ন ধাতু টিটেনিয়াম, যা ইলমেনাইটে থাকে। আর এটি আমাদের সমুদ্রসৈকত, ব্রহ্মপুত্রের প্রবেশমুখ এলাকার বালুতে সর্বোচ্চ পরিমাণে আছে।

এ ছাড়া ধারণা করা হচ্ছে, জয়পুরহাটে চুনাপাথর খনিতে মোট ১২০০ মিলিয়ন টন চুনাপাথর মজুদ আছে। নেত্রকোনা জেলায় প্রাকৃতিকভাবে আছে সাদামাটি বা হোয়াইট ক্লে এবং অবকাঠামোগত নির্মাণ ও কাচ তৈরির একমাত্র উপযুক্ত সিল্কি বালু। সাদা মাটি দিয়ে সিরামিকজাতীয় সামগ্রী নির্মাণ হয়। খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ মাটি তুলছে। জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও নেত্রকোনা সদর উপজেলার সায়রাতভুক্ত সাতটি বালুমহাল আছে। কিন্তু এগুলোর পরিবহনে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাতে হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের জরিপের মাধ্যমে গত বছর নওগাঁয় বড় চুনাপাথরের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সেখানে আনুমানিক ১০ হাজার কোটি মেট্রিক টন চুনাপাথর থাকার সম্ভাবনা আছে। নসরুল হামিদ বলেন, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চুনাপাথরের খনি। দেশের সব সিমেন্ট কারখানায় এই চুনাপাথর ব্যবহার করেও রফতানি করা যাবে। বর্তমানে দেশেই দুই কোটি মেট্রিক টনের চুনাপাথরের চাহিদা আছে। এ ছাড়া সিলেটের সুনামগঞ্জেও আছে উন্নতমানের বালু, চুনাপাথর, নুড়িপাথর ও কয়লা।

আরও খবর