মানুষের মন কেড়েছে রাহামত উল্লার বাহারী স্বাদের পানের খিলি

শাহীন মাহমুদ রাসেল :

আগেকার দিনে রাজা-বাদশাহরা শাহী পান খেতেন বলে জনশ্রুতি আছে। নানা গল্পগাথায় রাজ-রাজরাদের পানবিলাসের এন্তার বর্ণনা মেলে। সেসব পান সাজানো হতো দুর্লভ সব মসলা দিয়ে। মেশানো হতো বহুমূল্য সুগন্ধি।

সেদিন আর নেই। তারপরও কক্সবাজারের আনাচে-কানাচে টিকে আছে দু’একটি শাহী পানঘর। রাজা-বাদশাহদের দিন না থাকলেও এসব শাহী পানঘরে ব্যবসাপাতি মন্দা–এমন কথা বলা যাবে না। সদরের বাংলা বাজারে থাকা একটি শাহী পানঘরে দৈনিক বেচাকেনা প্রায় ১০ হাজার টাকা। বিশেষ দিনে পান সরবরাহের অর্ডার পেলে এই অংক গিয়ে দাঁড়ায় ২০ থেকে ৩০ হাজার। এখানকার দোকানি রাহামত উল্লাহ একথা স্বীকার করেছেন নিজ মুখে।

তার দোকানে প্রতি খিলি পানের দাম ৫ টাকা থেকে ২০ টাকা। এত বহুমূল্য পানে কী মেশান-এমন প্রশ্ন করতেই মুচকি হাসেন রাহামত। দম না নিয়ে বলতে থাকেন কয়েক ডজন স্বাদ বৃদ্ধিকারী মসলার নাম। এ মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোরব্বা, খেজুর, খোরমা, তানশিন, তেরেঙ্গা, চমন বাহার, এলাচ, গুন্তি, তবক, ইমাম, শ্রীকান্ত, নারিকেল, কিসমিস, সেমাই, স্লাচ, ঝুড়া ইত্যাদি। তিনি বলেন, এসব মসলার সবক’টি দেশে পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বেশি আমদানি করতে হয় পাশের দেশ ভারত থেকে। তবে তাঁর দোকানে এক ধরণের তরল মসলা আছে যা তিনি নিজহাতে বানান। এটার নির্দিষ্ট কোনও নাম নেই- তারা এটাকে মসলার রস বলে। এই রসই তার দোকানের বিশেষত্ব।

রাহামত নিজে পান খান। অসাধারণ স্বাদু সুগন্ধী খিলিপানের জাদুকর তিনি। তার হাতে বানানো পান খেয়ে স্বাদ পাননি এমন ব্যক্তি নেই। এমপি-চেয়ারম্যান-সরকারি উচ্চ মহলের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণীর রাজনৈতিক ব্যাক্তিরা তার হাতের পান খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। এখনও লিংকরোড় ও বাংলা বাজারে কোনও অনুষ্ঠান-প্রোগ্রাম হলে ডাক পড়ে রাহামতের। সম্প্রতি রাহামতের দোকানের সামনে গিয়ে লক্ষ্য করা গেছে, পান নিয়ে ৪ জনের ব্যস্ততা। আর বিদ্যুৎগতিতে দুহাতে পানে বহুমূখি মসলা ছিটিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

দোকানের পাশে ১০ টাকা দামের খিলির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা দরগাহ পাড়ার বাসিন্দা আমিন বলেন, এ দোকান থেকে আমার বাবা আগে শাহী পান নিতেন। এখন আমি নিই। দিনে অন্তত ২০টি মিষ্টি পান লাগে। মাঝে মাঝে বাড়ির সবার জন্যও শাহী পান নিয়ে যাই। আমার নানী মিষ্টি পান খুব পছন্দ করেন। আর আমার ৭ বছরের ভাতিজা জুনায়েদও। অনেক বাচ্চা বাজার থেকে এলে চকলেট বা বিস্কুট-চানাচুর তালাশ করে। কিন্তু আমার ভাতিজা মিষ্টি পানের কথা জিজ্ঞেস করে। পান খেয়ে মুখ লাল করে। আমারও দেখে ভালো লাগে।

রাহামত বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে চলছে আমার এ শাহী পানের দোকান। তার পানের স্বাদের বিশেষত্ব কী জানতে চাইলে মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। পরে দুটি খিলি হাতে তুলে দিয়ে বলেন, এবার খাইয়া দেখেন, তাইলেই বুঝবেন। এখানে পানির মতো যে মসলাটা দিই সেটাই আমার পানের খিলির মূল স্বাদ আনে। গ্রামের বাড়ি ইটের গাঁথুনি দিয়েছেন পানের খিলির বদৌলতেই। পান-সুপারী আর নানান মশলা দিয়ে তৈরি একখিলি পান খেতে উৎসুক মানুষের দল শুধু কক্সবাজারে নয়, সারা দেশে পানের চাহিদা অন্যরকম।

তবে পানের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে প্রশ্ন করলে চিকিৎসকের অভিমত, বাহারি মসলায় রসে টস টস পান খেয়ে ক্যান্সারকে নিজের শরীরে ডেকে আনা ছাড়া এটা আর কিছু না। মেডিকেল সায়েন্স কখনোই পান খাওয়ার স্বীকৃতি দেয়নি। পানে ব্যবহৃত সুপারিতে উত্তেজক উপাদান থাকে। ফলে পান খাওয়ার পর দেহে উত্তেজনার অনুভূতি জাগে। এ কারণে অনেক সময় অ্যাজমা বেড়ে যাওয়া, হাইপারটেনশন বা রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, ট্যাকিকার্ডিয়া বা নাড়ির স্পন্দন বেড়ে গিয়ে অস্থিরতা অনুভূত হতে পারে।

ল্যাব এইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের ক্যান্সার স্পেশালিস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক কনসালট্যান্ট ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন (মুঠোফোন) বলেন, প্রত্যেক পানেই সুপারি এবং চুন মেশানো হয়। আর মুখাভ্যন্তরের ক্যান্সারের জন্য প্রধান দায়ী উপাদান হচ্ছে চুন-সুপারি। এর সঙ্গে জর্দা-তামাক তো আছেই। এসবের বিক্রিয়ার কারণে মুখের অভ্যন্তরে এবং খাদ্যনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তা ছাড়া পানে অধিক লালের জন্য ব্যবহৃত খয়ের এসট্রিনজেন্ট হিসেবে কাজ করে মুখের আবরণীকে সংকুচিত করে।

আরও খবর