ডেস্ক রিপোর্ট – ব্রেক্সিট চুক্তিতে টানা তিনবার পার্লামেন্টে পরাজিত হলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। বৃটেনের ইতিহাসে এতে নতুন এক অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। প্রথম দু’দফায় শোচনীয়ভাবে এমপিদের ভোটে পরাজিত হন তিনি। শুক্রবার তৃতীয় দফায় তার চুক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছেন ২৮৬ জন এমপি। বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ৩৪৪ জন। এ অবস্থায় চুক্তিবিহিন ব্রেক্সিট সম্পাদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কিছু এমপি। অন্যদিকে তেরেসা মে ইঙ্গিত দিয়েছেন জাতীয় নির্বাচনের। এ খবর দিয়েছে অনলাইন স্কাই নিউজ ও বিবিসি।
তেরেসা মে বলেছেন, আমার আশঙ্কা এই হাউসে এই প্রক্রিয়ার সর্বশেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছি আমরা। তার এ কথার মধ্যেই একটি সাধারণ নির্বাচনের ইঙ্গিত আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিবিসি লিখেছে, ব্রেক্সিটের জন্য এটিই ছিল একমাত্র চুক্তি যাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের সাথে বৃটেনের মতৈক্য হয়েছিল। কিন্তু এ চুক্তিটি পার্লামেন্টে এতটাই সমালোচিত হয় যে, পর পর তিনবার ভোটে দিয়েও তা পাস করাতে পারলেন না প্রধানমন্ত্রী মে। এর আগে বৃটেনের সামনে সময়সীমা দেয়া হয়েছিল যে, একটা চুক্তির ভিত্তিতে যদি ইইউ ত্যাগ করতে হয়- তাহলে ২৯শে মে’র মধ্যেই সেটা পার্লামেন্টে পাস করাতে হবে।
কিন্তু মিসেস মে’র আনা চুক্তিটিই যে শুধু পার্লামেন্টে পাস হয় নি তা নয়, তার আগে যেসব বিকল্প প্রস্তাব পার্লামেন্টে তোলা হয়েছিল সেগুলোর কোনটাই পাস হয় নি। এখন বৃটেনকে হয়তো কোন চুক্তি ছাড়াই ১২ই এপ্রিল ইইউ ত্যাগ করতে হবে। বিশেষজ্ঞ এবং ব্রেক্সিট-বিরোধীদের আশংকা, এর ফলে বৃটেনের অর্থনীতির গুরুতর ক্ষতি হবে।
অন্যদিকে ব্রেক্সিট সমর্থকদের একাংশ বলছেন, মিসেস মে’র চুক্তিতে যে ব্যাকস্টপ পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, তাতে উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং বৃটেনের বাকি অংশ- এ দুইয়ের জন্য দুই নিয়ম চালু হবে। তাদের মতে, এক দেশে দুই নিয়ম থাকতে পারে না এবং এর ফলে উত্তর আয়ারল্যান্ড কার্যত যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, বৃটেন আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে কখনোই ইইউ থেকে বেরুতে পারবে না।
পার্লামেন্টে মিসেস মে’র প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বিরোধীদল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, মিসেস মে যদি তার প্রস্তাবে পরিবর্তন আনতে না চান, তাহলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিসেস মে’র প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে পাস না হবার পর এখন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এর মধ্যে কোন চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট, আদৌ ব্রেক্সিট না হওয়া বা বিলম্বিত হওয়া, নতুন কোন প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়া, নতুন করে ইইউতে থাকা-না-থাকা প্রশ্নে গণভোট, মিসেস মে’র পদত্যাগ ও নতুন কারো প্রধানমন্ত্রী হওয়া, অথবা নতুন নির্বাচন- এরকম অনেক সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রধান ব্রেক্সিট আলোচক মিশেল বার্নিয়ার বলেছেন, বৃটেন এর পর কি করতে চায়- তা ব্রাসেলসকে জানানোর জন্য এপ্রিলের ১২ তারিখ পর্যন্ত সময় আছে।
স্কাই নিউজ লিখেছে, ২৯ শে মার্চ ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কার্যকর অর্থে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়ার শেষ দিন। এদিন যখন তেরেসা মে হাউস অব কমন্সে তার চুক্তি ভোটে দিলেন তখন ওয়েস্টমিনস্টারের বারে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেন। এমপিরা এই চুক্তির পক্ষে ভোট দিয়ে তাদেরকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনুন এমনটাই চাইছিলেন তারা। এ ছাড়া আগেই প্রধানমন্ত্রী তেরেসো মে প্রস্তাব দিয়েছেন যদি পার্লামেন্ট তার চুক্তিকে পাস করে তাহলে, তিনি নির্ধারিত সময়ের আগেই পদত্যাগ করবেন। সম্ভবত এমন প্রস্তাবের পরে শেষ মুহূর্তে অবস্থানের পরিবর্তন করেছেন তেরেসা মে’র নিজ দল কনজার্ভেটিভ পার্টির শক্তিধর এমপি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন, জ্যাকব রিস-মগ ও ডমিনিকি রাব। তা সত্ত্বেও তেরেসা মে’র বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তার ৩৪ জন এমপি। আয়ারল্যান্ড সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগে তাদের পাশাপাশি অবস্থানে অটল থাকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডিইউপি। এ ছাড়া বিরোধী লেবার পার্টিও এই চুক্তির বিপরীতে অবস্থান নেয়। তবে এ দলটির মাত্র ৫ জন এমপি চুক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
ডয়েচে ভেলের খবরে বলা হয়েছে, তৃতীয়বারের মতো চুক্তি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ফলে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট অথবা দীর্ঘ বিলম্ব অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এবার ১২ই এপ্রিলের মধ্যে বৃটেনকে বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হবে। পূর্বের মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী শুক্রবারই ব্রেক্সিট কার্যকর হবার কথা ছিল। এই দিনেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৃটেনের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত চুক্তি অনুমোদন করার মরিয়া প্রচেষ্টা চালান প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। কিন্তু যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই প্রস্তাব ৫৮ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলো।
এর ফলে আগামী ১২ই এপ্রিলের মধ্যে বৃটেনকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ব্রেক্সিটের বিকল্প পথ দেখাতে হবে। আগামী ১০ই এপ্রিল ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের আগেই বৃটেনকে পরবর্তী পদক্ষেপ জানাতে হবে। তা না হলে হয় চুক্তিহীন ব্রেক্সিট, অথবা গোটা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ বিলম্ব মেনে নিতে হবে। আপাতত সংসদে অন্য কোনো বিকল্পের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। অথচ সংসদ সদস্যরা এমন পরিস্থিতির ঘোর বিরোধী। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মে আরও একবার ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করার চেষ্টা চালাতে পারেন বলে গুঞ্জন উঠেছে।
জটিলতা এড়াতে তেরেসা মে শুক্রবার শুধু বিচ্ছেদ চুক্তিটি ভোটাভুটির জন্য পেশ করেছিলেন। অর্থাৎ শুক্রবার ইইউ-র সঙ্গে বৃটেনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়ে রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র নিয়ে ভোটাভুটির প্রচেষ্টা করে নি সরকার। এই ‘পার্থক্য’ সম্পর্কে স্পিকার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে নিজের ছাড়পত্র দিয়েছেন। ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদিত হলে পরে আলাদা করে ঘোষণাপত্রটি অনুমোদনের চেষ্টা চালানোর পরিকল্পনা ছিল সরকারের।
প্রধানমন্ত্রী মে ব্রেক্সিট চুক্তির পক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করতে পারবেন কিনা, শুক্রবার সকালেও তা স্পষ্ট ছিল না। কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিদের মধ্যে অনেকে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ ও অনিশ্চিত বিলম্বের বদলে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করে ইইউ-র সঙ্গে বিচ্ছেদের বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, চুক্তি অনুমোদিত হলে আগামী ২২শে মে বৃটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করতো। নতুন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তখন ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে ইইউ-র সঙ্গে দরকষাকষি করা সম্ভব হতো। কিন্তু ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ দলের একাংশ ও জোটসঙ্গী ডিইউপি দলের সংসদ সদস্যরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্রেক্সিট চুক্তির বিরোধিতায় অটল থাকায় সেই প্রচেষ্টা বিফল হলো। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন আগেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছিলেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-