কক্সবাজারে মানবপাচারসংক্রান্ত বিচারাধীন মামলা ৪০১

বিশেষ প্রতিবেদক :

কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের হালনাগাদ (ফেব্রুয়ারি-২০১৯) মামলার বিবরণী তালিকায় মানবপাচারসংক্রান্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪০১।

বুধবার আদালতের সেরেস্তা থেকে সংগৃহীত মানবপাচার মামলার বিবরণীতে দেখা গেছে, এসব মামলায় সাজার কলাম শূন্য, খালাস শূন্য, অব্যাহতি শূন্য, অন্যভাবে বদলি শূন্য, এমনকি মোট নিষ্পত্তির কলামটিও শূন্য।

মানবপাচার নিয়ে ২০১২ সালে গঠিত ট্রাইব্যুনালটিতে (বিশেষ আদালত) গত আট বছরে একটি মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ জামিনে গিয়ে পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা আবারও ফিরে গেছে পাচারের নৃশংস কাজে। কক্সবাজারসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা রোহিঙ্গা শিবিরের পাচারকারীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে উপকূলীয় ও সীমান্ত এলাকায় রমরমা পাচার কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।

২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মো. বাদশা মিয়া নামের এক ব্যক্তি তার শিশুপাচারের অভিযোগ এনেছিলেন হাসিনা আকতার জলি নামের এক নারীর বিরুদ্ধে। কক্সবাজারের ট্রাইব্যুনালে এটিই ছিল এক নম্বর ক্রমিকে মানবপাচারে দায়ের করা মামলা। এ মামলায় দুই দফায় তদন্তেও পুলিশ ঘটনার সত্যতা খুঁজে পায়নি। এ কারণে মামলাটি আর এগোয়নি। একই বছরের ২৮ আগস্ট পারভিন আকতার নামের এক নারী ওসমান গনি নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাচারের মামলা করেন। সেটি ছিল দুই নম্বর মামলা। এ মামলায়ও আগেরটির অবস্থা দাঁড়ায়।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার দক্ষিণ চাকমারকুল মিয়াজীপাড়া থেকে অপহরণের পর পাচারকালে চার বছরের শিশু নকিউদ্দিনকে র‌্যাব সদস্যরা উদ্ধারের পর আটক করেন তিন পাচারকারীকে। ২০১২ সালের ২৮ আগস্টের এ ঘটনা নিয়ে থানায় মামলা করেন শিশুটির বাবা মুহাম্মদ হারুন। রামু থানার পুলিশ ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর তিন পাচারকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে। ওই আসামিরা কিছুদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পায়। মামলার অভিযোগ গঠন হয় ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল। কিন্তু এরপর মামলার বাদী ও সাক্ষীদের হাজির করা যাচ্ছে না। ফলে নিষ্পত্তির মুখ দেখছে না মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের মামলাটি। এ রকমই ৪০১টি পাচারের মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে কক্সবাজারের ট্যাইব্যুনালে।

কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (স্পেশাল পিপি) এবং জেলা বিএনপি নেতা মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ‘দেশে একটি বিশেষ অপরাধের ঘটনা যখন বৃদ্ধি পায় তখন সরকার এ রকম অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যই বিশেষায়িত আদালত অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে থাকে। কক্সবাজারে এ রকমই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১২ সালে। সারা দেশের মধ্যে মানবপাচারের সবচেয়ে বেশি ঘটনা কক্সবাজারে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠনের দীর্ঘ আট বছরের মধ্যে একটি মামলাও নিষ্পত্তি করতে না পারার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

অ্যাডভোকেট শাহাবুদ্দিন আরো বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তির জন্য কেবল ট্রাইব্যুনাল দিলেই হবে না; লজিস্টিক সাপোর্ট যা দেওয়ার কথা তার তেমন কিছুই দেওয়া হয় না। এমনকি দেওয়া হয় না পলাতক আসামির বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিলের টাকা পর্যন্ত।’

কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বর্তমান বিশেষ পিপি এবং জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্তে সীমাহীন দুর্বলতাই মামলা নিষ্পত্তি করতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ। তদুপরি মামলার ভিকটিম, বাদী, সাক্ষী ও আসামিরা একেকজন একেক এলাকার বাসিন্দা। এ কারণে একটি নির্দিষ্ট তারিখে মামলার পক্ষভুক্ত সবাইকে আদালতে উপস্থিত করা অসম্ভব হয়। এসব কারণেই মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।’

তিনি আরো বলেন, মামলার আসামিদের বেশির ভাগই দেশের নানা প্রান্তের বাসিন্দা হওয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের অনেককে শনাক্ত না করেই অভিযোগপত্র দিয়ে থাকেন। এসবও মামলা নিষ্পত্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

গত চার মাসে বিজিবি, র‌্যাব, কোস্ট গার্ড ও পুলিশ কক্সবাজারে কমপক্ষে ১০টি বড় ধরনের মানবপাচারের চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। এই জেলাবাসীর অনেকের মতে, মানবপাচারকারীর শাস্তি না হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে মানবপাচারের প্রধান রুট কক্সবাজারের সাগরপথে পাচার থামছে না কিছুতেই।

সর্বশেষ গত মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে পুলিশ পাচারকালে উদ্ধার করেছে ৩১ জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুকে। এ ঘটনায় পুলিশ মহেশখালী থানায় পাচারের মামলা দিলেও একজন আসামিকেও এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

পাচার নিয়ে ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কক্সবাজারের রামুর খুনিয়া পালং ইউনিয়নের কৃষক দানু মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে শাহাবুদ্দিনকে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য দালালের সাথে চুক্তি হয়েছিল দেড় লাখ টাকার। সেই চুক্তির পর দালালরা হয়ে পড়ে মানুষখেকো। আর সেই মানুষখেকোদের চার লাখ টাকা দিয়েই আমার কলিজার টুকরোকে প্রাণে রক্ষা করেছি।’ দানু মিয়া বলেন, তিন মাস আগের ঘটনা এটি।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে সাগরপথে দানু মিয়ার ছেলে শাহাবুদ্দিন, প্রতিবেশী আদম আলীর ছেলে রুবেল ও মোস্তাকের ছেলে তারেক মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়। তিনি দেড় লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন। থাই-মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছার পর মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের সেখানকার ‘জল্লাদ বাহিনীর’ হাতে গিয়ে পড়ে শাহাবুদ্দিন ও তার দুই সঙ্গী। জল্লাদ বাহিনী মোবাইল ফোনে ভিডিও কল করে তাঁর ছেলেকে গলায় ছুরি ধরে থাকার দৃশ্য দেখিয়ে আরো আড়াই লাখ টাকা দাবি করে।

ভয়ে অসহায় কৃষক দানু মিয়া সুদে ধারদেনা করে আড়াই লাখ দালালের হাতে তুলে দেন। এভাবে দুই দফায় চার লাখ টাকা নেওয়ার পরই তাঁর ছেলে মুক্তি পেয়ে এখন কাজ করছে মালয়েশিয়ায়।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার খুনিয়া পালং ইউনিয়নের কেচুবনিয়া গ্রামের আলী আহমদের ছেলে আবদুল খালেক মানবপাচারের দালাল হিসেবে চিহ্নিত। তার বিরুদ্ধে পাঁচ-ছয়টি পাচারের মামলা রয়েছে। বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কারাগারে গেছে। আবার জামিনে বের হয়ে ফিরে গেছে একই পথে। কৃষক দানু মিয়া জানান, তাঁর গ্রামের এই আবদুল খালেক তাঁর সন্তানসহ তিনজনকে পাচারেরও অন্যতম হোতা।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাশিম ওরফে পোয়া মাঝি (৪০) একজন ভয়ংকর পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। আদালত সূত্রে জানা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে ৯টি পাচারের মামলা রয়েছে। কিন্তু তিনি সব মামলায় জামিন পেয়ে আবারও মানবপাচারের কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর সিন্ডিকেটের একজন পাচারকারী নুরুল আলম ছয় বছর আগের একটি মামলায় গতকাল ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেছেন, মানবপাচার আবারও ব্যাপকভাবে শুরু করার কাজ চলছিল। কিন্তু সীমান্তে ইয়াবাপাচারের পাশাপাশি মানবপাচারের বিষয়টি নিয়েও অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে পুলিশ। তিনি বলেন, ‘টেকনাফ এবং উখিয়ায় ইতিমধ্যে ইয়াবা কারবারিদের মতো করে বেশ কয়েকজন মানবপাচারকারীও বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।’

আরও খবর