বাংলা ট্রিবিউন :
মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে সড়ক, রেল ও নৌপথে ইয়াবা পাচার অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ইয়াবা পাচারে আকাশপথকে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। আকাশপথে ইয়াবা আনার জন্য বিভিন্ন কৌশলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ‘বিপদজনক’ কৌশল হলো পেট এবং গোপনাঙ্গ ব্যবহার করে ইয়াবা বহন। কারো বিরুদ্ধে কোনও গোয়েন্দা তথ্য বা কারো চলাফেরায় সন্দেহজনক কিছু মনে না হলে এই পদ্ধতিতে আনা ইয়াবা বা বহনকারীকে আটক করা সম্ভব না। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইয়াবার মতো মাদক চিহ্নিত করার মতো কোনও স্ক্যানারও নেই। আর সে সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা।
তবে বিমানবন্দরে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বিমানবন্দরে মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে সম্মতি প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে আধুনিক যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে। এরই মধ্যে ডুয়েল ভিউ এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন, ডুয়েল ভিউ স্ক্যানিং মেশিন, লিকুয়েড এক্সপ্লোসিভ ডিটাকশন সিস্টেম (এলইডিএস), আন্ডার ভেহিকল স্ক্যানিং সিস্টেম (ইউভিএসএস), ফ্যাপ বেরিয়ার গেট উইথ কার্ড রিডার, বেরিয়ার গেট উইথ আরএফআইডি কার্ড রিডার, এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস), এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেকশন (ইটিডি) যন্ত্র বসানো হয়েছে।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, যাত্রীদের ব্যাগেজ তল্লাশির জন্য বিমানবন্দরগুলোতে স্থাপিত এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন, ডুয়েল ভিউ স্ক্যানিং মেশিন এবং এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (এলইডিএস) ধাতব ও বিস্ফোরকদ্রব্য শনাক্ত করতে সক্ষম হলেও মাদকদ্রব্য বিশেষ করে ইয়াবার মতো মাদক শনাক্ত করতে সক্ষম নয়। এসব মেশিনের মাধ্যমে মদের বোতল, বিয়ারসহ সহজে দৃশ্যমান বড় আকৃতির প্যাকেটজাত মাদক শনাক্ত করা সম্ভব।
বিমানবন্দরে মাদক শনাক্তের এই দুর্বলতার ফাঁকে আকাশপথে ব্যবহার করে ইয়াবা বহনকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, একজন বাহক তার স্টমাকে (পেট) করে দুই থেকে আড়াই হাজার পিস ইয়াবা বহন করতে পারে। আর এই ইয়াবা বহন করার জন্য ঢাকা থেকে বাহকরা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় আকাশপথে যায় এবং পেটে ইয়াবা নিয়ে আকাশ পথেই আবার ঢাকায় ফিরে আসে।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর দেয়া তথ্য মতে, গত বছরের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৮৯৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ২৬টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বরে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৭ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা। ইয়াবাসহ আটক করা হয়েছে ১৯ জনকে এবং মামলা হয়েছে ১৪টি।
এরইমধ্যে শনিবার (২৩ মার্চ) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮০০ পিস ইয়াবাসহ ফরিদ আহমেদ (২৫) নামে এক যাত্রীকে আটক করে এপিবিএন। তাকে দুপুর পৌনে ২টার দিকে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের বহিরাঙ্গন থেকে আটক করা হয়। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সযোগে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসেন ফরিদ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের বহিরাঙ্গন থেকে আটক করা হয়। পরে তার পাকস্থলী এক্সরে করে ৮০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পেটে করে ইয়াবা বহন করে দীর্ঘ সময় থাকা অত্যন্ত বিপদজন বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। হাজারো ইয়াবা থাকা প্যাকেটগুলোর কোনও একটা লিক (ছিদ্র) করে বহনকারী মারা যাওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও গোয়েন্দা প্রধান আব্দুর রহমান।
ইয়াবা দীর্ঘ সময় পেটে নিয়ে চলাচল করলে শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতাও দেখা দেয়। যে কারণে বাহকরা সড়ক, রেল ও নৌপথে দীর্ঘ সময় যাতায়াত করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাদের চলাফেরা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সন্দেহভাজন এই চলাফেরা আঁচ করতে পেরে বাহককে অনেক সময় বিভিন্ন স্টেশনগুলোতে ধরে ফেলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাই পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এবং দ্রুত সময়ে ইয়াবার চালান ঢাকায় আনতে আকাশপথকে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা।
মাদকবিরোধী অভিযান সংশ্লিষ্টরা জানান, আকাশপথে লাগেজে করে বা কোনও বস্তুর ভেতরে লুকিয়ে ইয়াবা আনলে বিমান বন্দরের স্ক্যানারে তা ধরা পড়ে। এছাড়া সন্দেহ হলে সেগুলো খুলেও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কেউ যখন পেটে করে ইয়াবা নিয়ে আসে তখন তা সাধারণ স্ক্যানারে ধরা পড়ে না। কাউকে সন্দেহ হলে বা কারো বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য থাকলে তাকে এক্সরে কক্ষে নিয়ে গিয়ে তার পাকস্থলী পরীক্ষা (এক্সরে) করা হয়। তখন পেটে কিছু লুকানো থাকলে তা ধরা পড়ে। কিন্তু গোপন তথ্য বা সন্দেহজনক চলাফেরা ব্যতীত পেটে করে ইয়াবা বহনকারীকে চিহ্নিত করা কঠিন বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা আর্মড পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক বিমানবন্দরে পেটে বা গোপনাঙ্গে ইয়াবা বহনকারী চিহ্নিত করার বেশ কঠিন। সে লক্ষ্যে এপিবিএনসহ আমরা সবাই নজরদারি জোরদার করেছি। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন হলে আশা করছি, এই চোরাচালান অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’
২০১৮ সালের গত ৩ মে র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে র্যাব সদর দফতরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের এই এলিট ফোর্সকে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ দেন। এরপর ৫ মে এপ্রিল থেকে সারাদেশে অভিযান শুরু করে র্যাব। এরপর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অভিযানে নামে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা। যা এখনও চলমান রয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-