ডেস্ক রিপোর্ট – কক্সবাজারের শরনার্থী শিবির থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে ১ লাখ ৩০ লাখ হাজার রোহিঙ্গা স্থানান্তর নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারের সার্বিক প্রস্তুতি থাকলেও এনজিও ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন (ইউএনএইচসিআর) নিরাপত্তা ঝুঁকির ‘অজুহাত’ তুলে এর বিরোধিতা করছে। তবে সরকার রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বলে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরু হলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা আরো প্রায় তিন লাখসহ কমপক্ষে এগারো লাখ বাড়তি মানুষ এখন উপজেলা দুটির শরণার্থী শিবিরে অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে।
কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে এক লাখের মতো রোহিঙ্গা স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ভাসানচরে ৪৫০ একর জমির ওপর আশ্রয় শিবির নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।তাই রোহিঙ্গা স্থানান্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার।
এনজিওদের বিরোধীতার কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলে ইউএনএইসসিআর, আইওএম, অক্সফাম, এমএসএফ, সেভ দ্যা চিল্ড্রেন, রেডক্রস-রেডক্রিসেন্ট, ওয়াল্ড ভিশন, কেয়ার,কর্নসার্ন, মুক্তি,রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল,টিকা,মুসলিম এইড, একশন এইড, হেন্ডিক্যাপ, রেসকিউ, ক্রিস্টিয়ান এইড,প্লান, মোয়াস, ডাব্লিউএফপি, কোস্টট্রাস্ট,কুয়েত-কাতার রেডক্রিসেন্ট,মালয়শিয়া ফিল্ড হসপিটাল,মুসলিম হেন্ডস,আদ্রা সহ অসংখ্য দেশি-বিদেশি এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের দফতরগুলোও সেখানে নিতে হবে। আর এসকল এনজিও কর্মকর্তাদের ওই চরে থাকতে হবে। তাদের ছাড়তে হবে কক্সবাজারের বিলাসবহুল তারকা সুবিধার হোটেল ও মোটেল।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের হুটহাট বিমান যাত্রাও বন্ধ হয়ে যাবে। মূলত: এসব কারণেই বিদেশি এনজিওরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে স্থানীয়দের ধারণা। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিদেশি এনজিও ও সংস্থাগুলো চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ১শ’ ৫০ কোটি শুধু হোটেল ভাড়া পরিশোধ করেছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেয়ার নামে বিদেশি এনজিওরা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা এনেছে।
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে বলেছেন, বিদেশি এনজিওদের অর্থেও ৭৫ ভাগ খরচ হয় তাদের প্রতিনিধিদের আসা-যাওয়া ও থাকা খাওয়ায়। তারা মাত্র ২৫ ভাগ অর্থ ব্যয় করেন রোহিঙ্গাদের সহায়তায়। এটা খুবই দুঃজনক ও পীড়াদায়ক ব্যাপর।
গত সপ্তাহে নতুন সরকারের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির প্রথম বৈঠক স্বরাষ্ট্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্র্রশ্নের জবাবে এ কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা এ কাজ শেষ করতে পারবেন।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসি আর) সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল হক বলেন, আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ কোথায় রাখবেন, এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। এক্ষেত্রে ইউএন বডির বলার কিছু নেই। এটুকু তারা দেখবেন, রোহিঙ্গাদের আমরা (বাংলাদেশ) কোনো অমানবিক পরিবেশে রাখছি কি না। সে রকম কিছু ঘটলে ইউএন বডি বলতে পারে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করলেও রোহিঙ্গাদের কারণে পুরোপুরিভাবে কঠোর হতে পরছে না। মিয়ানমার থেকে মাদক প্রবেশও কাক্সিক্ষতমাত্রায় ঠেকাতে পারছে না। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের একটি গ্রুপ চোরাই পথে ইয়াবাসহ মাদক আনছে। মাদকবহনকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হতে পারছে না। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর রাতভর লোক চলাচল করে। এদের সঙ্গে অসৎ উদ্দেশ্য পরিচালিত কিছু এনজিও কর্মীদের সখ্যতা গড়ে উঠেছে। যা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা ২৩ হাজার পরিবারের লাখের বেশি সদস্যকে ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি ও পাহাড় ধসের কারণে তাদের জীবন বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। আগামী এপ্রিল মাস থেকে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। এ মাস থেকেই তাদেরকে ভাষানচরে স্থানান্তরের কাজ শেষ করতে চায় সরকার।
ঝড়-বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে রোহিঙ্গাদের জীবন বিপন্ন হলে সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের দুর্নাম হবে। সেই দায় এড়াতে চায় সরকার। রোহিঙ্গাদের এটা বলা হয়েছে, তারা ভাসানচরে গেলে সুখে থাকবে। সেখানে মাছ শিকার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ করার সুযোগ পাবে। এ সব সুবিধাদি সরকারই তাদের নিশ্চিত করবে। কিন্তু জাতিসংঘের একজন মহিলা কর্মকর্তাসহ বিদেশি এনজিওগুলো এই কার্যক্রমের বিরোধিতা করছে। রোহিঙ্গারা ভাসানচরে স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে সরকার কাউকে জোর করে নেবে না।
গত শনিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএম আবদুল মোমেন এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা চাইছিলাম আগামী মাসে ঝড়-বৃষ্টি শুরুর আগেই ২৩ হাজার পবিবারকে (১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা) ভাসানচরে ‘মুভ’ করতে। কারণ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে পাহাড় ধসে তাদের জীবন বিপন্ন হবে। এই দায়ভার আমরা নিতে চাই না। কিন্তু জাতিসংঘের একজন মহিলা কর্মকর্তাসহ কিছু এনজিও আছে তারা এটা চায় না।
তার পরেও এ বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশের একটি সচেতন মহলও রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের স্থানান্তরের পক্ষে নয়, এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলে, মিয়ানমার তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার আর আগ্রহ দেখাবে না। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর এলাকা ঘুরে দেখে ঘরগুরৈাকে কারাগারের সঙ্গে তুলনা করছেন। কারণ প্রত্যেকটি ঘরে গ্রিল থাকায় এটাকে কারাগারের সঙ্গে তুলনা করছেন। ওনারা গ্রিল বিহীন বাড়ির কথা বলছেন। মিয়ানমারের রাইন স্টেট থেকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক রয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হওয়া ৭০ হাজার নারী রয়েছে। তারা ইতোমধ্যে ৭০ হাজার শিশুজন্ম দিয়েছেন।
একশ্রেণির এনজিও স্থানান্তর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোকে অশান্ত করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলিতে একজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে গত সপ্তাহে। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে কর্মরতরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে স্থান সংকুলন না হওয়ায় তাদেরকে ছোট ঘরের মধ্যে গাধাগাধি করে অনেকটা অমানবিক পরিবেশে থাকতে হচ্ছে। তাদের একটি মানবিক পরিবেশে বসবাসের জন্য ভাসানচরে ঘর করে দিয়েছে সরকার। বিদেশি এনজিও গুলো সরকারের এই উদ্যোগের নিরপত্তার ধুয়া তুলে বিরোধিতা করছে। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, ভাসানচরসহ গোটা উপক‚লীয় এলাকায় বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ বসবাস করছে।তারা ওই, এলাকায় ঝড়-বৃষ্টি ও জলোচ্ছ¡াসকে সঙ্গী করে বসবাস করছেন। তাদের তো নিরপত্তায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
এব্যপারে কক্সবাজার বাচাঁও আন্দোলনের এক নেতা কক্সবাংলাকে জানান, রোহিঙ্গাদের চাপে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।তারা জেলার সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে।
ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে খুন, ডাকাতি, অপহরণ,ছিনতাই সহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা।তা সত্বেও মানবিকতার অজুহাতে তাদের জন্য প্রতিনিয়ত মায়াকান্না ও নানা সাফাই গেয়ে বিরোধীতা করে যাচ্ছে দেশি-বিদেশি এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ।যা সম্পূণ বেআইনি এবং তারা তা কোনভাবেই চাপিয়ে দিতে পারে না।সবকিছুই তাদের সুবিধা মত হবে তা ভাবাটা ঠিক নয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-