নতুন দৃষ্টান্ত :মাদক সংক্রান্ত ঘটনায় মানি লন্ডারিং আইনে আসামিদের সাড়ে ৮ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোকের আদেশ

বাপবেটার ইয়াবা কারবার: রিকশাচালক থেকে কোটিপতি

সাহাদাত হোসেন পরশ, সমকাল :

তারা রিকশা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করতেন ২০০৯-১০ সালেও। অভাবের সংসারে তিনবেলা পরিবারের সব সদস্যের খাবারও জুটত না ঠিকমতো। কিন্তু গোলাপি বড়ি জীবন বদলে দিল তাদের। তিন বাপবেটা মিলেমিশে শুরু করলেন ইয়াবা কারবার। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে সময়, জীবনের চালচিত্র। একপর্যায়ে দেশব্যাপী তৈরি করেন তারা ইয়াবার বড় নেটওয়ার্ক। সেই গোলাপি বড়ির কল্যাণে বদলে যায় পুরো পরিবার, কোটিপতি বনে যান টেকনাফের নাজিরপাড়ার এজাহার মিয়া (৭০) এবং তার দুই ছেলে নুরুল হক ভুট্টো (৩২) ও নূর মোহাম্মদ (৩৫)।

২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট এ চক্রের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয় টেকনাফ মডেল থানায়। এরই মধ্যে ওই মামলার তদন্ত শেষ করেছে সিআইডি। সেখানে ইয়াবার কারবারে তিন বাপবেটার এ গ্রুপের ৬০ জনের নাম উঠে এসেছে। এজাহার ও তার দুই ছেলের প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে তিন বাপবেটা জামিন নেওয়ার পর কোথায় রয়েছেন, তা জানা নেই সংশ্নিষ্টদের। সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এর আগে কক্সবাজারে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সময় আলোচনায় আসে তাদের সম্পদের বিষয়টি।

এ ব্যাপারে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বছর দেড়েক আগে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার দুটি মাদক মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডি এ চক্রের বিপুল সম্পদের খোঁজ পায়। এরপর মাদক মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। মাদক থেকে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার ঘটনাটি সেটি প্রথম ছিল। এ মামলার তিন আসামির সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।’ 

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এ মামলার তদন্তে উঠে এসেছে- এজাহার মিয়া ও তার দুই ছেলে আটটি ব্যাংক ও চারটি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের মাধ্যমে ১৮২টি হিসাব নম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাদক বিক্রির অর্থ সংগ্রহ করতেন। এ অর্থে তারা নির্মাণ করেছেন দুটি বিলাসবহুল বাড়ি। কক্সবাজার শহর ও টেকনাফে নয় স্থানে জমি কিনেছেন। মাদকের অর্থ দিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করতেন তারা। 

তদন্ত সূত্র বলছে, এজাহার মিয়ার ছেলে ভুট্টো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। এজাহার ও তার দুই ছেলে কখনও নিজে, কখনও বাহকের মাধ্যমে ইয়াবার চালান টেকনাফ থেকে ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, জয়পুরহাট, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিতেন। পুরো এ চক্রে আরও যারা রয়েছেন- কক্সবাজারের নাজিরপাড়ার

নুরুল আলমের ছেলে জালাল উদ্দিন ও আবছার উদ্দীন, মো. বেলাল, জালিয়াপাড়ার মো. আরিফ, আবদুর রহমান, অলিয়াবাদের নুরুল মোস্তফা, ডেইলপাড়ার মোহাম্মদ তৈয়ব, কলেজপাড়ার নুরুল কবিরের ছেলে রাশেদুল ইসলাম, হেলাল, মো. কামাল, মোহাম্মদ হাসান, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার আবদুল কাদেরের ছেলে মোজাহার আলম, কুলালপাড়ার মৃত আলী আহমদের ছেলে আবু তাহের, মিরপুর ১০ নম্বরের বাসিন্দা মো. হামিদ, নরসিংদীর বাঘাটার মৃত চান মিয়ার ছেলে মো. রাসেল, মুন্সীগঞ্জের উত্তর কাজী কসবার জাফর শেখের ছেলে রিয়াজ, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার মৃত রুস্তম আলীর ছেলে আবদুল কুদ্দুস, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দুর্গাপুরের সুমাইয়া আক্তার রানী, জামালপুরের তালাশের মনির হোসেনের ছেলে নাঈম হোসেন, কুমিল্লার মুরাদনগরের মৃত আশরাফ আলীর ছেলে মো. শাহজালাল, গাজীপুরের টঙ্গীর সোহেল আহমেদ, ঢাকার পল্লবীর আবদুর রহিম জনি, পশ্চিম শেওড়াপাড়ার মো. স্বপন, চাঁদপুর সদরের আফজাল হোসেনের ছেলে সালাউদ্দিন, মধ্য বাড্ডার গোলাম ফারুক, নরসিংদী সদরের মধ্যনগর এলাকার বজলুর রহমানের ছেলে রায়হান খান, মধ্য বাড্ডার আফরোজা আক্তার এ্যানী প্রমুখ। 

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘মাদক একটি জাতীয় সমস্যা বিবেচনায় মানি লন্ডারিং আইন, ২০১২ (সংশোধনী-২০১৫)-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী মূল তিন আসামির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের আবেদন করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারের বিশেষ জজ আদালত মূল তিন আসামির সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন।’ 

এখন এই সম্পদ কারা দেখভাল করবে- এটা জানতে চাইলে নাজিম উদ্দিন আরও বলেন, ‘ক্রোক করা সম্পদ জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপার দেখভাল করতে পারেন। আদালত হয়তো পরবর্তী আদেশে সেটা বলবেন। সম্পদ ক্রোকের আদেশের অনুলিপি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও জেলা রেজিস্ট্রার অফিসে দেওয়া হয়েছে।’ 

আরও খবর