গত বছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই ৪৬টি গাড়ি আমদানি করে বিতর্কে জড়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। তারা শুল্ক দেওয়া থেকে রেহাই চায় এবং এই আবদারের পেছনে সংস্থাটির যুক্তি ছিল, হলুদ নম্বর প্লেটের (কূটনৈতিক গাড়ি) এই গাড়িগুলো ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের’ কাজে কক্সবাজারে সরকারি বিভিন্ন অফিসে ব্যবহার হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই আবদার প্রত্যাখ্যান করলেও তাদের গাড়ি আমদানি বন্ধ থাকেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়েছে। বিষয়টি পরে তদন্তেও গড়িয়েছে।
কক্সবাজার ডায়াবেটিস হাসপাতাল ও বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের কাছে খালের পাশে একটি ফলকে লেখা আছে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা খালটি সংস্কারে সহায়তা করেছে। জানা গেছে, শুধু এই খালই নয়, কক্সবাজারে অনেক সরকারি দপ্তরের অবকাঠামো সংস্কারের কাজেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কাজ করা দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, সরকারি দপ্তরকে এই সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বলে, এর মাধ্যমে তারা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও সহায়তা করছে। তবে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোই আবার কোনো না কোনোভাবে ওই সংস্থাগুলোর প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন নজরদারির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই ওই সব প্রকল্পের অর্থ ব্যয় নিয়েও তেমন তথ্য পাওয়া যায় না।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় যে বিদেশি সহযোগিতা আসছে তার কত ভাগ ওই সংস্থাগুলোর অফিস ব্যবস্থাপনা, কর্মীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি কেনা ও যাতায়াতের পেছনে ব্যয় হচ্ছে আর রোহিঙ্গারা কতটা পাচ্ছে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তথ্য দেয় না। আর এতে অর্থ নয়ছয়ের বড় সুযোগ তৈরি হয়। গত কয়েক দিনে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।
দেশের এনজিওবিষয়ক ব্যুরো এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখে। অন্যদিকে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর অর্থ ব্যয়ের হিসাব তাদের নিজস্ব কাঠামো অনুযায়ীই নিরীক্ষা করা হয়। গত বছরের শুরুর দিকে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে বিভিন্ন সংস্থার সরবরাহ করা জিনিসপত্র নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে কম এবং সেগুলোর দাম বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দেখানোর মতো অনিয়ম ধরা পড়ে। এর পর বেসরকারি সংস্থাগুলোকে (এনজিওগুলোকে) তাদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো আট দফা নির্দেশনাও দিয়েছিল। কিন্তু এরপরও অস্বচ্ছতার ঝুঁকি কমেনি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। বৈশ্বিক উদ্যোগ ‘ইন্টারন্যাশনাল এইড ট্রান্সপারেন্সি ইনিশিয়েটিভে (আইএটিই)’ সহায়তার টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ‘হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাডভাইজারি গ্রুপ’ ও ‘নিরাপদের’ ‘স্থানীয়করণের প্রায়োগিক বাস্তবতা, রোহিঙ্গা সংকটে সাড়াদানের প্রথম ১০০ দিনের কর্মকাণ্ডে স্থানীয় নেতৃত্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সে সময় রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের ৬৯ শতাংশই বরাদ্দ পায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা, অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডাব্লিউএফপি)। আন্তর্জাতিক এনজিও এসিএফ পেয়েছে ৭.৮ শতাংশ। দেশের সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্র্যাক পেয়েছে ২.১ শতাংশ এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পেয়েছে ১.৩ শতাংশ তহবিল।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্থানীয় স্বত্বাধীন এবং স্থানীয়ভাবে পরিচালিত একটি মানবিক ব্যবস্থার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অর্থাৎ তাদের লক্ষ্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার স্থানীয় ও জাতীয় সাড়াদানকারীদের কাছে হস্তান্তর করা। কিন্তু তুরস্কে সই হওয়া ‘গ্র্যান্ড বার্গেইন কমিটমেন্ট’ অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে কর্মরত সংস্থাগুলোর জন্য সরাসরি ২৫ শতাংশ তহবিল বরাদ্দ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন দেখা যায়নি। সরকারের সঙ্গে শরণার্থী সাড়াদান কর্মকাণ্ড সমন্বয়ের জন্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) ‘নেতৃত্বদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। কেননা শরণার্থী বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বদানকারী সংস্থা হলো ইউএনএইচসিআর।
বাংলাদেশে হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাডভাইজারি গ্রুপের জাতীয় পরামর্শক ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. নাদিরুজ্জামান গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এ দেশে তিন ধরনের রোহিঙ্গা আছে। একটি হলো রিফিউজি (শরণার্থী), যাদের সংখ্যা ৩০ হাজার। বাকি দুটির একটি আনডকুমেন্টেড মিয়ানমার ন্যাশনালস (২০১৬ সালের অক্টোবরের আগে এসেছে কিন্তু শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃত হয়নি) এবং অন্যটি ‘আন-অথরাইজড মিয়ানমার ন্যাশনালস’ (যারা ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে এসেছে)। এই ব্র্যান্ডিংগুলোর সঙ্গে তাদের ‘এনটাইটেলমেন্ট’ যেমন সম্পৃক্ত, তেমনি সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতাও সম্পৃক্ত। যখন যে ‘রিফিউজি’ হবে তখন সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইউএনএইচসিআরের এখতিয়ারে চলে আসে। আন-অথরাইজড মিয়ানমার ন্যাশনালসের ক্ষেত্রে দায়িত্ব আইওএমের।
স্থানীয়করণের অর্থ হলো মানবিক সহায়তা ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সক্ষমতা, কারিগরি দক্ষতা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। স্থানীয়করণ উপেক্ষিত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সরকার উদ্যোগ না নিলে স্থানীয়করণ হবে না। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরকারের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাদের কাজের বিষয়ে সরকার জানতে চাইতে পারে। সুতরাং সরকার কেন এ জায়গায় চ্যালেঞ্জ করছে না?’
‘কক্সবাজার সিএসও-এনজিও ফোরামের (সিসিএনএফ)’ কো-চেয়ারম্যান ও বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী গত শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বিদেশি তহবিলের প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। বাকি ২০ শতাংশের ৭ শতাংশ আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশনের (আইএফআরসি) মাধ্যমে ব্যয় হয়। অবশিষ্ট ১৩ শতাংশের মধ্যে ১১ শতাংশ আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (আইএনজিও) এবং মাত্র ২ শতাংশ স্থানীয় এনজিওগুলোর মাধ্যমে ব্যয় হয়।
তিনি বলেন, “আমাদের সমালোচনা জাতিসংঘের সংস্থা ও আইএনজিও—দুই পক্ষের ব্যাপারেই। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও আইএনজিওগুলো ২০১৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে ‘গ্র্যান্ড বার্গেইনিং কমিটমেন্টে’ সই করে। সেখানে ১০টি ধারার মধ্যে একটি ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে : বিদেশিদের খাতে, ব্যবস্থাপনা খরচসহ পুরো হিসাব প্রকাশ করতে হবে। অর্থাৎ আমি যে খরচ করছি তা বেশি হচ্ছে কি না এবং সেটি আরো কিভাবে কমানো যায় সে ব্যাপারে স্থানীয় সাংবাদিকরা যাতে সমালোচনা করতে পারেন, পরামর্শ দিতে পারেন সেটিই এর লক্ষ্য।” তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এখন আমি যদি তথ্য প্রকাশই না করি তাহলে সাংবাদিকরা কিভাবে সমালোচনা করবেন?’
ঢাকা ও কক্সবাজারের বিভিন্ন সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রায় এক হাজার ৩০০ জন বিদেশি কাজ করছে। তাদের মধ্যে ৯০০ জন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় এবং বাকি ৪০০ জন বিভিন্ন আইএনজিওতে কাজ করছে। এ ছাড়া প্রায় ৬০০টি গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিসিএনএফের কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন আমি যদি চ্যালেঞ্জ করি জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও আইএনজিওগুলো গাড়িগুলোর পেছনেই বেশি খরচ করছে আর অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিদেশিদের কাজ দিচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের কাছে ন্যূনতম তহবিলও যাচ্ছে না?’
স্বার্থের কারণেই জাতিসংঘ ও আইএনজিওগুলো এখানে তৎপর বলে মনে করেন সিসিএনএফের কো-চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘যখন টাকা-পয়সা আর আসবে না তখন আস্তে করে তারা পালিয়ে চলে যাবে। বাংলাদেশের সরকারের ওপর, আমাদের ওপর, আপনার-আমার ঘাড়ের ওপর এগুলো পড়ে যাবে। তখন লোকালাইজেশন (স্থানীয়করণ) হবে।’
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের সহযোগী বেসরকারি সংস্থাগুলো এ বছর রোহিঙ্গা সংকটে সাড়া দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ৯২ কোটি চার লাখ ৬১ হাজার ২৭৩ মার্কিন ডলার (প্রায় সাত হাজার ৭২৬ কোটি টাকা) তহবিল চেয়েছে। যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায় (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান, সংক্ষেপে জেআরপি) স্থান পাওয়া ৫০টি সংস্থার বেশির ভাগই বিদেশি সংস্থা। গত বছরের ৮ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর গ্র্যান্ড বার্গেইন তার বাংলাদেশ মিশন শেষে জাতিসংঘ সংস্থা ও আইএনজিওগুলোকে স্থানীয়কৃত মানবিক সাড়াদানের রূপরেখা প্রণয়ন এবং মানবিক সহায়তাবিষয়ক তথ্য প্রকাশের সুপারিশ করেছিল; কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
/কালের কন্ঠ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-