মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ::
ইয়াবার চালান আসা থামছে না
অর্থ যায় দুবাই সিঙ্গাপুর হয়ে মিয়ানমার
মরণ নেশা ইয়াবা মাদক নির্মূলে শেষ কোথায়- এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল মহলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার অবসান হচ্ছে না। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবচেয়ে বেশি জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা চালান আসা রোধে। ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে ‘চল যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে দেশব্যাপী যে অভিযান শুরু হয়েছে- এ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ইয়াবার বিরুদ্ধে। কিন্তু আগের ন্যায় স্রোতের মতো আসছে না বটে, তবে বিভিন্নভাবে চালান আসা থামানো যাচ্ছে না। এর মূল কারণ হিসাবে এখন উঠে আসছে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ পথে এ ব্যবসার নেপথ্যে অর্থপাচারের বিষয়টি। মূলত হুন্ডির অর্থেই সর্বনাশ বলে সর্বাধিক আলোচিত।
মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ও ইয়াবা কারবারিদের নিজেদের অন্তর্কোন্দলে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৫২ জন। এছাড়া অভিযান শুরু হওয়ার পর ইয়াবার চালান আটক হয়েছে প্রায় ৭ কোটি পিস। অপরদিকে, ইয়াবা কারবারে জড়িতদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে ১০২ জন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারী তালিকায় লিস্টেড হয়েছে মোট ১৬৫১। এর মধ্যে পুরনো রয়েছে ১১৫১। নতুন নাম এসেছে আরও ৫শ। এছাড়া প্রথম দফায় বেরিয়ে এসেছে ৩০ হুন্ডি ব্যবসায়ীর নাম। এদের সকলেই কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ার বাসিন্দা। মূলত এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীরাই ইয়াবা চালান নিয়ে আসার বিপরীতে অবৈধ পথে অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার করে দেয়ার মূল হোতা। এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কেউ এ পর্যন্ত ধরা যেমন পড়েনি, আত্মসমর্পণও করেনি। ইয়াবা নির্মূলে যেসব মহল চিন্তা ভাবনা বা গবেষণা চালাচ্ছেন তাদের বিভিন্ন সূত্র মতে বলা হচ্ছে, ইয়াবার চালান আসার বিপরীতে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার রোধ করা না গেলে এই মরণনেশা ট্যাবলেটের চালান আসা রোধ করাও সহজ কোন বিষয় নয়। বিভিন্ন সূত্রের মতে, হুন্ডির অর্থ চলে যায় দুবাই-সিঙ্গাপুর হয়ে মিয়ানমারে। দেশে যেমন রয়েছে হুন্ডি ব্যবসায়ী, তেমনি রয়েছে দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মিয়ানমারে। এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীরা মূলত ইয়াবা চালানের বিপরীতে অর্থ পৌঁছে দেয়ার আসল গডফাদার। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইয়াবার চালান চলে আসে গডফাদারদের ইশারায় বাকিতে। পরে তা হুন্ডির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ পৌঁছে যায়। আর এ রুটটি হচ্ছে বাংলাদেশ-দুবাই-সিঙ্গাপুর-মিয়ানমার।
অপরদিকে, অনুসন্ধানে এটা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু পর্যন্ত নাফ নদীর বিস্তৃতি। বিস্তৃত এ সীমান্ত এলাকাজুড়ে বিজিবির পাহারা ছাড়া অন্য কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। কিন্তু মিয়ানমার পক্ষ ওপারজুড়ে নির্মাণ করে রেখেছে কাঁটাতারের বেড়া। এ প্রক্রিয়ায় এপারের প্রায় ৭২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা উন্মুক্তই রয়ে গেছে। তবে এ সীমান্ত এলাকাজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রস্তাবটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে।
মাদক ইয়াবার বিরুদ্ধে কক্সবাজার অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার অভিযান জোরদার হওয়ার পর নাফ নদী হয়ে সীমান্তের ওপার থেকে ইয়াবার চালান আসা হ্রাস পেলেও এর গতিপথ পাল্টে বড় একটি অংশ সমুদ্রপথ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। যে কারণে এখনও প্রায় দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার পক্ষ বহু আগেই প্রতিষ্ঠা করেছে ৩৭টি ইয়াবা উৎপাদনের কারখানা। এ বিপুলসংখ্যক কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে ইতোমধ্যে কয়েক দফায় মিয়ানমার পক্ষকে ওইসব কারখানা বন্ধের সুপারিশ জানানো হলেও এতে কার্যকর কোন সুফল বয়ে আসেনি। অর্থাৎ ওই ৩৭ কারখানায় নিয়মিত ইয়াবা উৎপাদিত হচ্ছে এবং তা বিভিন্ন পথে বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। পাঠানোর এ প্রক্রিয়ায় সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অর্থাৎ পুলিশ, বিজিপি ও সে দেশের সেনাবাহিনী সহযোগিতায় নিয়োজিত রয়েছে। কারণ, ওসব ইয়াবা উৎপাদনকারীর কারখানার মালিকানায় রয়েছে সে দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও উর্ধতন সেনা কর্মকর্তাগণ।
ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের পর পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে মরণনেশা এই মাদকের চালান বাংলাদেশে অবৈধ পথে চলে আসায় পথে পরিপূর্ণভাবে প্রতিবন্ধকতার কোন দেয়াল সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। এত ধরপাকড়, ক্রসফায়ার ও বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা চালান আটকের ঘটনার পরও থামানো যাচ্ছে না। রুট পরিবর্তিত হয়ে ইয়াবার চালান ঠিকই চলে আসছে, যা এদেশের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ইয়াবাসহ মাদক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে উচ্চ ক্ষমতার সিসিটিভি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, বিগত এক বছরে দেশে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৭৮টি মাদকের মামলা হয়েছে এসব মামলায় আসামি হয়েছে ৬১ হাজার ৩২৩ জন। এছাড়া ২৮ হাজার ১৪১ প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি গঠিত হয়েছে। এছাড়া যে সব ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পুনর্বাসনের চিন্তা করছে বলেও জানান দিয়েছেন। আবারও এটাও উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছেন ইয়াবা জগতের গডফাদাররা জীবন বাজি রেখে হলেও তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে চাইবে। এর পাশাপাশি ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা সারাদেশে এতই বেড়েছে যে, খুব সহজে এবং স্বল্প সময়ে এর শতভাগ নির্মূল করা হয়ত সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসল কথাই জানান দিয়েছেন। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এদেশ থেকে হুন্ডি পথে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে বলেই ওপার থেকে ইয়াবার চালান আসছে। মূলত, ২০০৬ সাল থেকেই বাংলাদেশে ইয়াবা চালান আসার গতি বেড়ে যায়। এর আগে এসেছে স্বল্পসংখ্যক। পরবর্তীতে তা বেড়েছে। একপর্যায়ে তা ব্যাপকতর রূপ ধারণ করেছে। সীমান্ত সংলগ্ন পুরো টেকনাফ পরিণত হয় ইয়াবা শহরে। দ্রুততম সময়ে বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলার মানসে এ ব্যবসায় জড়িয়েছে অনেকেই। এদের কেউ বিনিয়োগকারী, কেউ মজুতকারি আর কেউ ক্যারিয়ার। আবার এদের অধিকাংশ রোহিঙ্গা। ওপারের সঙ্গে সব দিক দিয়ে এদের যোগাযোগ সহজ বিধায় রোহিঙ্গারা এ কাজে জড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া টেকনাফসহ গোটা কক্সবাজার অঞ্চলে অবস্থান করছে। দেশী-বিদেশী সাহায্যে এরা জীবন চালাচ্ছে অতি সহজেই। আর বাড়তি আয়ের জন্য আরও বিভিন্ন সুযোগ নিজেদের আওতায় নিয়ে এসেছে। যার মধ্যে মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে দেয়া অন্যতম।
/জনকন্ঠ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-