শাহীন মাহমুদ রাসেল :
উখিয়া-টেকনাফে সিএনজি অটোরিকশায় নৈরাজ্য থামছে না। এতে করে অতিরিক্ত ভাড়া গোনাসহ হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
ভুক্তভোগিদের মতে, রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে কেন্দ্র করে অঘোষিত ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভাড়া বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে একদিকে যাত্রীরা যেমন দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছে তেমনি প্রতিনিয়ত হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। চালকদের স্বেচ্ছাচারিতাও এক বিন্দু কমেনি। অন্যদিকে, মালিকরাও চালকদের কাছে থেকে বাড়তি জমার টাকা আদায় করে চলেছেন। সব মিলে অটোরিকশা সেক্টরের নৈরাজ্যে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম।
বিআরটিএ-এর দাবি তারা এই নৈরাজ্য দুর করতে সচেষ্ট। বিআরটিএ-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে কেউ অভিযোগ করলে তা যাচাই করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ ছাড়া নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে। সাড়ে বারো লাখেও বেশি রোহিঙ্গাদের সেবা দেওয়া সাধারণ এনজিও কর্মচারীদের ও স্থানীয়দের নির্ভরযোগ্য যান সিএনজি অটোরিকশা। মধ্যবিত্তদের নির্ভরযোগ্য যান বলে পরিচিত সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হননি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে।
ভুক্তভোগিদের অভিযোগ, ভাড়া করতে গেলেই অটোরিকশার চালকরা এমন ভাব করেন যেনো যাত্রীদেরকে তারা করুণা করছে। ইউএনডিপির কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন বলেন, উখিয়া থেকে কক্সবাজার সিএনজি ভাড়া ৮০ টাকা, কোটবাজার, মরিচ্যা থেকে ৭০ এবং ৬০ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু এনজিও কর্মচারীদের কেন্দ্র করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। অঘোষিত অতিরিক্ত ভাড়াকে কেন্দ্র করে যাত্রীরা চরম লাঞ্চনার স্বীকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলার সাবেক সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিদ্দিক আহম্মদ বলেন, উখিয়া-টেকনাফে কোনো অটোরিকশাই এখন আর আগের মতো ভাড়া কমম নেয়না এ কথা সত্য। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ও এনজিও কর্মচারীদের জন্য তিনশত অটোরিকশা কোনোভাবেই যথেষ্ঠ নয়। এই সঙ্কটের সুযোগ নিচ্ছে মালিকপক্ষ। তারা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো চালাচ্ছে। এতে চালকরা বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।
ছিদ্দিক আহম্মদ আরোও বলেন, এই অরাজকতা বন্ধ করতে হলে নতুন ৫ শত অটোরিকশা নামাতে হবে। তখন মালিক ও চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অনিয়ম আর থাকবে না।
সিএনজি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, এই সেক্টরে অরাজকতা বন্ধের জন্য চেষ্টা তো আর কম করলাম না। এজন্য মনিটরিং কমিটিও করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। তিনি বলেন, এখন তো প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশা চলছে, এনজিওদের কারণে একই ধরণের গণপরিবহনে স্বাভাবিকভাবেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের চালকরা প্রাইভেট অটোরিকশার চালকদের সাথে পেরে না উঠতে পেরে তারাও মিটারে যেতে চায় না। বরকত উল্যাহ বুলু বলেন, তারপরেও আমাদের অধিকাংশ চালকই অনেকটাই সহনশীল। তবে তারা ১০/২০ টাকা বেশি দাবি করে এটাও ঠিক।
ভুক্তভোগিদের মতে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অথচ এখনও বেশিরভাগ কোনো নিয়ম মানছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে অটোরিকশা চালক আব্দুল জব্বার বলেন, রোহিঙ্গা আসের পর থেকর একবার গেলে জামজটের কারণে ফিরে আসতে সারাদিন লেগে যায়, নির্ধারিত এই ভাড়ায় গেলে আমাদের পোষায় না। বাড়তি এই টাকার জন্যই আমাদেরকে বাড়তি টাকা আয় করতে হয়।
আরেক চালক বদিউজ্জামান বলেন, আমরা সারাদিন পরিশ্রম করে যে টাকা রোজগার করি তা যদি মালিককেই দিয়ে দেই তাহলে খাবো কী। মালিকতো কোনো নিয়মকানুন মানে না। প্রতিদিন ৬শ’ টাকা জমা না দিলে আমাকে আর গাড়ি দেবেনা, আমি না নিলে নেয়ার মানুষের অভাব নাই। বাধ্য হয়ে মালিকের অন্যায় আবদারকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। ওই চালক বলেন, যাত্রীদের সাথে আমরা অন্যায় করছি-এটা বুঝি। কিন্তু এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এ প্রসঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের এক সার্জেন্ট বলেন, আইন করেও সিএনজি অটোরিকশা সেক্টরকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যাচ্ছে না। এর মালিক শ্রমিকরাই এতোটাই বেপরোয়া যে কোনো আইনেই এদেরকে বশ করানো যাচ্ছে না। কক্সবাজারে চলাচলরত ১ হাজার অটোরিকশার চাহিদার তুলনায় কম বলে এই স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সাথে যোগ হয়ে প্রাইভেট অটোরিকশা। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে এই প্রাইভেট অটোরিকশার সেক্টর।
সচেতন দাবী করেছেন, এদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয়ের পর থেকে যাত্রী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সুযোগ গ্রহণ করছে পরিবহন শ্রমিকরা। শ্রমিক সংগঠনগুলো ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও তা মানা হচ্ছে না। বেপরোয়া এসব যানবাহন শ্রমিকেরা যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায় করছে বলে জানিয়েছেন তারা।
পরিবহন সংগঠন সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার থেকে উখিয়া পর্যন্ত প্রতি যাত্রীর বিপরীতে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। উখিয়া থেকে বালুখালী ২০টাকা, বালুখালী হতে পালংখালী পর্যন্ত মাথাপিছু ২০ টাকা হারে সি.এন.জি ভাড়া নেওয়ার নিয়ম থাকলেও সি.এন.জি অটোরিক্সা,টমটম ও ছাড়পোকা চালকেরা এসব নিয়মনীতি তোয়াক্কা করছে না বলে যাত্রী সাধারণের অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা ইউএনও বরাবরে অভিযোগ করে জানিয়েছেন, কয়েকটি ভাগে বিভক্ত উখিয়ার পরিবহন সেক্টরে চলছে চরম নৈরাজ্য ও বাড়তি ভাড়া আদায়ের মত অনৈতিক ঘটনা। তারা সংগঠনের দাপট দেখিয়ে তিন চাকার এসব পরিবহন শ্রমিকেরা যাত্রীদের নিকট থেকে জোর করে তিনগুণ ভাড়া আদায় করছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বেশ কিছু তিন চাকার গাড়ির চালক জানিয়েছেন, রিজার্ভ যাত্রী ছাড়া তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন না। কিন’যাত্রীরা বলছেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করলে তাদের হাতে নাজেহাল হতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে একের পর এক অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্থানীয় পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে মিলিত হন।
এ সময় তিনি বলেন যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করার কারণে পথচারী, যাত্রী, ছাত্রছাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। এমনকি সড়ক দূর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুও ঘটনাও ঘটছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ ব্যাপারে তিনি পরিবহন মালিক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দেন এবং যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।
এদিকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজর টেকনাফ সড়কে ভারি যানবাহন চলাচলের উপর প্রসাশন নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা মানা হচ্ছে না। যে কারণে সড়কে দূর্ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক যানজট। এ ব্যাপারে উখিয়া ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মো. শাহজাহান জানান রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ার কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল নিয়ে ভারি যানবাহনগুলো ক্যাম্পে প্রবেশ করছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.
নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান সড়কে যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা ও যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গত আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় গৃহীত হয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-