১২ লাখ রোহিঙ্গার সংকট সমাধানে নতুন পদক্ষেপ

ডেস্ক রিপোর্ট – কক্সবাজারে আশ্রিত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে নতুন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জাতিসংঘ। তবে শুরুতেই রাশিয়া ও চীনের বিরোধিতার ফলে এ উদ্যোগের সফলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

সংশ্নিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘে যাওয়া একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা বাড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। মিয়ানমার এর সমাধানের বদলে সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।

রোহিঙ্গা সংকটের এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এ সংকট সমাধানে যত ধরনের তৎপরতা সম্ভব, সব ধরনের তৎপরতাই চালানো হবে। তিনি জানান, মিয়ানমারে আসিয়ান দেশগুলোর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠাসহ নতুন কয়েকটি প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা চলছে।

বিশ্নেষকরা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার  ভূমিকায় বড় পরিবর্তন ছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ এর আগেও  মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টির একাধিক উদ্যোগ এসেছে; কিন্তু চীন-রাশিয়ার অবস্থানগত কারণে কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। এর বিপরীতে ভারত, চীন, রাশিয়া এবং আসিয়ান দেশগুলোর তত্ত্বাবধানে ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে গেলে তার সফলতার সম্ভাবনা বেশি বলে মত দেন বিশ্নেষকরা। তারা বলেন, এ সংকট সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতাই বাংলাদেশের সামনে একমাত্র পথ। অতএব, মিয়ানমার যে পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা তার চেয়ে আরও বেশি গতিশীলতা এবং দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

জাতিসংঘের নতুন উদ্যোগ সম্পর্কে জানা যায়, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে যুক্তরাজ্য সম্প্রতি একটি প্রস্তাব দেয়। এতে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারকে চাপ দিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একাধিক স্তরে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। বিশেষ করে প্রস্তাবে মিয়ানমারের ওপর প্রথম পর্যায়ে সীমিত আকারে কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দেওয়া হবে।

পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্র জানায়, এ প্রস্তাবের খসড়া জাতিসংঘে জমা দেওয়ার পর এটি নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা বর্জন করেন। তবে দুই দেশের বর্জনের পরও কাছাকাছি সময়ে এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ও ভোটাভুটির জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করা হতে পারে; কিন্তু প্রস্তাবটি পাস হওয়া নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদে এটি পাস হতে ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে কমপক্ষে নয়টি দেশের সমর্থন লাগবে। অন্যদিকে পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের মধ্যে কোনো একটি দেশ ভেটো দিলেও প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যাবে। ফলে স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া প্রাথমিক আলোচনায় অংশ না নেওয়ায় প্রস্তাবটি পাস হওয়া নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।

অন্য একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে একাধিক সংস্থার প্রতিবেদন জমা পড়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ইয়াংহি লিও বছরের শুরুতেই পুনর্বার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তিনিও তার অধিকতর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। এসব প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হলে এর বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা বলা হয়েছে।

প্রথমত, বাংলাদেশে বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর জোরালো নেতিবাচক প্রভাবসহ এ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সংকট সৃষ্টির বড় ঝুঁকির কথা বলা হয়। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা দীর্ঘ সময় ধরে হতাশাগ্রস্ত হলে তাদের মধ্যে চরমপন্থা উদ্ভবের বড় ঝুঁকির কথা বলা হয়। এ ধরনের চরমপন্থা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বড় ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে।

অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত করতে মিয়ানমার নতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে মিয়ানমারজুড়েই বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন বাড়াচ্ছে এবং তাদের উগ্রপন্থায় যেতে উৎসাহিত করছে। এর লক্ষ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উগ্র কর্মকাণ্ডকে পুঁজি করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলা। এমনকি রাখাইনেও গত ডিসেম্বরে নতুন করে মিয়ানমার বাহিনীর অভিযান এবং এবার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাইরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর ওপরও নির্যাতন চালানো হয়।

বিভিন্ন প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণ থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আশঙ্কা বাড়লেও এ বিষয়ে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে কার্যত কোনো উদ্বেগ নেই। বরং রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে মিয়ানমারকে দায়মুক্তি দিতেই এ দুটি দেশকে বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে। এর বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধিতে বিকল্প বিভিন্ন উপায় খুঁজে দেখছে। এটাই এখন পর্যন্ত আশার বিষয়।

পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বড় অঙ্কের তহবিল সংগ্রহের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। কারণ, গত বছর বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা যে পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার ৫০ শতাংশও বাস্তবে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থা চলতি বছরও চলতে থাকলে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের নূ্যনতম চাহিদা মেটানো দুরূহ হয়ে পড়বে। এ বছর রোহিঙ্গাদের নূ্যনতম চাহিদা মেটাতে কমপক্ষে ৯৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে বলে হিসাব দিয়েছে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।

এ তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে বড় অর্থনীতির দেশ চীন আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংকটের ক্ষেত্রে যে ধরনের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকটে সে ধরনের সহায়তা দেয়নি। বরং গত বছর মিয়ানমারকে দেওয়া চীনা সহায়তার পরিমাণ রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মোট সহায়তার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি।

তবে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও খুব বেশি তৎপরতা নেই। এ সংকটে ভারত শুরু থেকেই মধ্যপন্থার নীতিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কাউকেই ‘অখুশি’ করা নয়- এ নীতিতেই এগিয়ে চলেছে ভারত। এশিয়ার অন্য প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে জাপানের ভূমিকাও ভারতের মতোই। জাপান এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে জোরালো কোনো বক্তব্য রাখেনি। মালয়েশিয়া মাঝে মধ্যে এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ফোরামে কিছু বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়েই তাদের ভূমিকা সীমিত রেখেছে। এশিয়ার বৃহত্তম মুসলিম প্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়াও মানবিক সহায়তা দেওয়ার বাইরে জোরালো কোনো ভূমিকা রাখছে না।

রোহিঙ্গা সংকটে সবচেয়ে হতাশাজনক ভূমিকা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর। এর একটা বড় কারণ মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলো নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সংকটে রয়েছে।

আরও খবর