কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের ৩০টি রোহিঙ্গা শিবিরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে। শিবিরগুলোতে অপহরণ, খুন, গুম, ধর্ষণসহ নানা ঘটনা এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো দখলে চলে যায় সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে। অভিযোগ উঠেছে, রাতভর এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা যার যেমন ইচ্ছা তেমনই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে শিবিরগুলোতে। এমন পরিস্থিতিতে শিবিরগুলো গণমাধ্যমকর্মী এবং বিদেশিদের জন্য আর মোটেই নিরাপদ নয় বলেও জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন।
কয়েক দিন ধরে শিবিরগুলো সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এক দল সশস্ত্র রোহিঙ্গার ব্যাপক অপতৎপরতার খবর পাওয়া গেছে। তাদের কাছে রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র। তারা ভিন্নমতাবলম্বীদের, বিশেষ করে দেশে ফিরে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গাদের গুম করে ফেলে। দলটির সদস্যদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্যতম অভিযোগ উঠেছে, তারা সুন্দরী নারীদের একদম ফ্রিস্টাইলে তুলে নিয়ে যায়। রাতের বেলায় মা-বাবা বা স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে ভোরে আবার ফিরিয়ে দেয়। কেউ টুঁ শব্দটিও করতে পারে না।
সাধারণ রোহিঙ্গারা এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাকে ‘আল-ইয়াকিন’ গ্রুপের সদস্য হিসেবে জানে। তবে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা নিজেদের একটু বড়মাপের সন্ত্রাসী পরিচয়ে ভয়ভীতি জাগানোর উদ্দেশ্যে বলে থাকে, তারা কথিত আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) সদস্য। কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধি অনেক সাধারণ রোহিঙ্গার সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করলেও তারা ওই সন্ত্রাসীদের বিষয় নিয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। তারা বলে, কোনো কিছু বললেই সন্ত্রাসীরা রাতে ধরে নিয়ে গুম করে ফেলবে।
তবে রোহিঙ্গা শিবিরে অপহরণ-গুমের কথা স্বীকার করেন শিবির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা (সিআইসি) মো. রেজাউল করিম। কালের কণ্ঠকে উদ্বেগজনক তথ্য দিয়ে বলেছেন, এ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই শতাধিক ব্যক্তি অপহরণ-গুমের শিকার হয়েছে। তিনি এমনও বলেছেন, অপহরণ-গুমের চেয়ে ভয়াল ঘটনা ঘটছে রোহিঙ্গা নারীদের নিয়ে। প্রতি রাতেই সুন্দরী নারীদের তুলে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। যারা অভিযোগ দিচ্ছে, তাদের ওপরও হামলে পড়ছে সন্ত্রাসীরা।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি কুতুপালং শিবিরের সিআইসি রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি শুধু এক রাতেই আমার আওতাধীন শিবিরের সাতজন নারীকে সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। এসব ধর্ষিত রোহিঙ্গা নারীর স্বজনরা আমাকে জানিয়েছে এ কথা।’ তিনি বলেন, ‘রাতের বেলায় শিবিরের অবস্থা যে কী হয় তার পুরো বর্ণনা দেওয়াও সম্ভব নয়।’ সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য হামলা থেকে রক্ষা পেতে তিনি এ সময় এই প্রতিবেদককে দ্রুত শিবির ছেড়ে যেতেও পরামর্শ দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি কুতুপালং শিবিরের লম্বাশিয়া চৌরাস্তা নামক এলাকায় জার্মান সরকারি টেলিভিশনের তিন সংবাদকর্মীসহ আট ব্যক্তি সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের হামলার শিকার হয়।
রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে মোড় নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়েরও। তিনি বলেন, ‘দেখুন, জার্মান টেলিভিশনের একটি সাংবাদিক দল রোহিঙ্গাদের মানবিক কাহিনি তুলে ধরতে একটানা সাত দিন ধরে কাজ করছিল। অথচ যাদের জন্য মানবিকতা দেখাতে সাংবাদিকরা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাঁদের ওপর রোহিঙ্গারা অমানবিকতা দেখাতে একটুও পিছপা হয়নি।’ ওসি বলেন, জার্মান তিন সাংবাদিকের সঙ্গে ঢাকার একজন সংবাদকর্মী এবং তাঁদের গাড়িচালকও মারধরের শিকার হয়েছেন। এমনকি সাংবাদিকদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার তিন সদস্যও রোহিঙ্গাদের মার খেয়েছেন। ঘটনার ব্যাপারে চার শতাধিক সন্ত্রাসী রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১ রোহিঙ্গাকে।
রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক দায়িত্বে থাকা উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ‘শিবিরের পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়। সশস্ত্র রোহিঙ্গার সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। দিন দিন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। শিবিরে নানা কাজের নামে থাকা বিপুলসংখ্যক এনজিওকর্মীরাই এমন পরিস্থিতির জন্য আংশিক দায়ী।’
সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা রাতে খুঁজতে থাকে তাদের ভিন্নমতাবলম্বীদের। তারা যাদের ধরে নিয়ে যায়, তাদের কারো খোঁজ মেলে আবার কারো মেলে না। যেসব রোহিঙ্গা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে, তাদেরও প্রতিপক্ষ গণ্য করছে সন্ত্রাসীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুতুপালং শিবিরের একজন রোহিঙ্গা আলেম কালের কণ্ঠকে জানান, শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবার আরাকানি অনুবাদ দিতে গিয়ে তাঁরা সন্ত্রাসীদের শত্রু হয়ে পড়ছেন। রোহিঙ্গা এই আলেম আরো জানান, সন্ত্রাসীরা রাখাইনে ফিরে যেতে চায় না। তারা শিবিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। অন্যদিকে শিক্ষিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েই খুশি। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি উন্নত হলে তারা ফিরে যেতে চায় বাপ-দাদার ভিটায়।
সিআইসি রেজাউল করিম বলেন, সন্ত্রাসীরা অপহরণের সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের এমনভাবে শাসিয়ে দেয়, যাতে জীবনের ভয়ে কেউই আর এ সম্পর্কে তথ্য দিতে রাজি হয় না। এ কারণেই অপহরণের ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে না।
তবে ভয়ভীতি উপেক্ষা করেও স্বজনরা অপহরণের বিষয়ে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে। রওজিয়া বেগম নামের একজন রোহিঙ্গা নারী তাঁর স্বামী মৌলভি আবুল হাশেমকে অপহরণের ঘটনা নিয়ে আদালতে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে উখিয়া থানার পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছে। অপরদিকে নুর কামাল নামের আরেক রোহিঙ্গার অপহরণ নিয়েও থানায় মামলা হয়েছে। দুই মামলার বাদীই এখন সন্ত্রাসীদের ভয়ে শিবিরের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে রোহিঙ্গা অপহরণ ও রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরের সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা সর্দার নুরুল আলম গত শুক্রবার ভোরে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর ওই রাতেই একই শিবিরের একজন নিরীহ রোহিঙ্গাকে সন্ত্রাসীরা খুন করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, আবদুল হামিদ নামের একজন সাধারণ রোহিঙ্গাকে প্রতিপক্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে।
/কালেরকন্ঠ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-