রোহিঙ্গা সংকটই প্রাধান্য পাবে

ফাইল ছবি

ডেস্ক রিপোর্ট – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন জার্মানি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত ইস্যু প্রাধান্য পাবে।বিশেষ করে জার্মানিতে অনুষ্ঠেয় মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে রোহিঙ্গা সংকটের ফলে সৃষ্ট নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয় তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী।

বর্তমান মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। দু’দেশের সফরেই নিরাপত্তার বিষয় মূল এজেন্ডা হলেও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো সমর্থন চাইতে পারেন। জার্মানিতে তিনি মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে যোগ দেবেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স এক্সিবিশন (আইডেক্স-২০১৯) কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন। তবে আমিরাতে দেশটির নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে জনশক্তির বন্ধ দুয়ার খোলার প্রতি বেশি জোর দেয়া হতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ১৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখ নগরীতে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে। এতে যোগদান শেষে প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি সরাসরি যাবেন সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রধানমন্ত্রীর দুই দেশ সফরের বিস্তারিত তুলে ধরতে আজ সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন ও পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকও থাকবেন।

মিউনিখ সিকিউরিটি সম্মেলন হল নিরাপত্তা বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সম্মেলন। ১৯৫২ সাল থেকে জার্মান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে স্বাধীন কর্তৃপক্ষ এই সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২৬ দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধান সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে নিশ্চিত করেছেন। এর বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীরাও যোগ দেবেন।

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি, মিসরের প্রেসিডেন্ট আল-ফাত্তাহ সিসি, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি অন্যতম।

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন প্রতিরক্ষা নীতিবিষয়ক প্রধান ফেডিরিকা মগিরিনিসহ জাতিসংঘ, ন্যাটো, বিশ্বব্যাংক এবং অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা যোগ দেবেন। এতে পাঁচ হাজারের মতো প্রতিনিধি যোগ দেবেন।

ঢাকায় সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে  বলেন, ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হল রোহিঙ্গা সংকট। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয় সম্মেলনে তুলে ধরবেন।’ রোহিঙ্গা সংকট জটিল আকার ধারণ করেছে। মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু করা যায়নি। রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে চাননি। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় না গেলে তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না।

মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বিদ্রোহীদের ওপর সামরিক হামলা শুরু হওয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চীন, ভারত ও আসিয়ানের সমর্থন চায় বাংলাদেশ, যাতে এই সংকটের একটি আঞ্চলিক সমাধান হতে পারে। তবে মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ অব্যাহত রাখা ছাড়া রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করা হবে।

জানতে চাইলে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমদ মঙ্গলবার টেলিফোনে  জানান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে এজেন্ডাভুক্ত দুটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেবেন। এ দুটি ইস্যু হল স্বাস্থ্য খাত ও জলবায়ু পরিবর্তন।

এ দুই খাতে নিরাপত্তার ঝুঁকির বিষয়ে বাংলাদেশ আলোকপাত করবে। তিনি আরও বলেন, সম্মেলনের সাইডলাইনে অনেক দেশের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেয়ার অনুরোধ পাচ্ছি। তবে আমরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের চেয়ে সম্মেলনের প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।

বিশ্বব্যাপী ছোট ও বড় নিরাপত্তা সংকটই শুধু নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন আলাদা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা বিভিন্ন দিক বিশেষ করে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরক্ষা নীতিতে সহযোগিতা, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনীর সঙ্গে নিরাপত্তার সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়াও মিউনিখ সম্মেলনে সাইবার নিরাপত্তা, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, আন্তঃদেশীয় হুমকি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, প্রযুক্তি প্রভৃতির সঙ্গে নিরাপত্তার সম্পর্ক নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হবে। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের তরফে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্বেগ তুলে ধরা হবে।

আরব আমিরাত সফর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছেন। তিনি জার্মানি থেকে সরাসরি আরব আমিরাত আসবেন। নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর এটিই হবে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম আরব আমিরাত সফর। দেশটির উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশীদ আল-মাকতুমের আমন্ত্রণে তিনি এই সফর করছেন। প্রধানমন্ত্রী এই সফরে ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স এক্সিবিশন (আইডেক্স-২০১৯) কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন।

পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সেদেশে বাংলাদেশি শ্রমবাজার উন্মুক্ত ও সম্প্রসারণে করণীয় বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন। এছাড়া স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম ইস্যু আলোচনায় আসতে পারে। এর পাশাপাশি তথ্য, কৃষি, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে সহযোগিতা, কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য অব্যহতি চুক্তি এবং কাস্টমসের ক্ষেত্রে সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয়াদি সফরের আলোচনায় স্থান পেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর আরব অমিরাত সফর উপলক্ষে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে এজেন্ডা নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রস্তুতিমূলক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যপত্র সূত্রে এসব আভাস পাওয়া গেছে।

ওই সভায় পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংযুক্ত আর আমিরাতের সফরের সময় দেশটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ সফরে ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স এক্সিবিশনে (আইডেক্স-২০১৯) অংশগ্রহণ করবেন। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।

এ সফরে মন্ত্রী পর্যায়ে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আরব আমিরাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই এই শ্রমবাজার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত হবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান মঙ্গলবার টেলিফোনে এ প্রসঙ্গে  বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতি এখনও চলছে।’ এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আর কিছু বলেননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে আড়াই-তিন লাখ বাংলাদেশি নিয়োগ পেত। কিন্তু ২০১২ সালের আগস্ট থেকে আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ কার্যত বন্ধ। বিগত বছরগুলোয় দুটি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

এর ধারাবাহিকতায় প্রায় সব বাংলাদশিকে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ইস্যু করা হয়। তাছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের প্রবণতাও কমে এসেছে। ফলে আরব আমিরাত বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত আরব আমিরাত সরকার অনিয়মিতভাবে অবস্থানরত প্রবাসীদের বৈধকরণের লক্ষ্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেয়। ফলে সেদেশে অবস্থানরত প্রায় ৫০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি তাদের চাকরি বৈধ করার সুযোগ পায়।

এছাড়া ইতিমধ্যে ১৯ ক্যাটাগরিতে গৃহকর্মী নিয়োগের বিষয়ে এপ্রিল ২০১৮-এ একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। চিকিৎসা ও প্রকৌশল খাতেও বাংলাদেশি পেশাজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশটি তাদের বিধিনিষেধ তুলে নেয়। ওই দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি সাধারণ কর্মীদের জন্য দ্রুত উন্মুক্ত হবে। নিরাপত্তা সংস্থা থেকে শিগগিরই এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

জানা গেছে, বাংলাদেশে আরব আমিরাতের নিবন্ধনভুক্ত কোম্পানিগুলোর মোট বিনিয়োগ প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের টেক্সটাইল, চামড়া শিল্প, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বায়োটেকনোলজি, পর্যটন, আইসিটি, এসব খাতে আরব আমিরাতের বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে।

টেকনাফে বাস্তবায়নাধীন পর্যটন প্রকল্প নাফ এবং সোনাদিয়ায় আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ করতে পারে। সারা দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক বা আইটি পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ খাতে বর্তমানে এক মিলিয়ন দক্ষ কর্মী কাজ করছেন। আর আমিরাত এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে।

আরব আমিরাত আগ্রহী হলে সেদেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি এক্সক্লুসিভ জোন বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। ডিস্যালাইনেশন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আরব আমিরাতের বিশেষ দক্ষতা আছে বিধায় এ দুটি খাতে তাদের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে শ্রমবাজার ইস্যুতে আরব আমিরাতে এক্সচেঞ্জ হাউসের শাখা খোলার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্তাব রাখতে পারে বলে জানা গেছে।

আরও খবর