আবদুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন :
সম্প্রতি দুই দফায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করেছে ভারত সরকার। ভারতে থাকলে একদিন আমাদেরও মিয়ানমারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তাই প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেকের মতো আমরাও দালালদের শরণাপন্ন হলাম। প্রতিজন ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে রাতের অন্ধকারে সীমান্তের দিকে রওনা দিলাম।’ সম্প্রতি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ষাটোর্ধ্ব রোহিঙ্গা নারী মরিয়ম খাতুন এভাবেই পরিস্থির কথা বর্ণনা করেছেন ।
সোমবার (১১ ফেব্রুয়ারি) কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে সঙ্গে কথা হয় তার সঙ্গে। ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার কারণ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ‘প্রাণ বাঁচাতেই পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা।’
মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘ভারতের হায়দরাবাদে আমার মেয়ে, জামাই ও নানি-নাতনি রয়ে গেছে। তারাও চলে আসবে যেকোনও সময়। শুধু তারা নয়, ভারতের সব রোহিঙ্গা চলে আসার চেষ্টা করছে বাংলাদেশে। কারণ মিয়ানমারের রাখাইনে মগদের হাতে আমাদের তুলে দিলে নিশ্চিত মৃত্যু। এছাড়া রাখাইনে এখন কেউ নেই। সবাই বাংলাদেশে চলে এসেছে। এই বাংলাদেশেই আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা রয়েছে।’
তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১২ সালেই পরিবারসহ দেশ (মিয়ানমারের রাখাইন) ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। এরপর সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। কিন্তু কোনও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থান না হওয়ায় ভারতের হায়দরাবাদে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যান তারা। তখন থেকে সেখানেই অবস্থান করছিলেন। ভালোই চলছিল সবকিছু। তবে সম্প্রতি ভারত সরকার সে দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তালিকা করে প্রত্যাবাসন শুরু করায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এখন মিয়ানমারে ফিরে গেলে নিজেদের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকেই রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন তারা।
এ প্রসঙ্গে মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার পর থেকে শুরু করে দমন-পীড়ন। একের পর এক কেড়ে নেওয়া হয় রাখাইনে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গাদের সব রাষ্ট্রীয় অধিকার। নানা অজুহাতে শুরু হয় নির্যাতন। এই নির্যাতনের এক পর্যায়ে ২০১২ সালে স্বামী-সন্তান নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আশ্রয় মেলেনি বেশিদিন। তাই উপায় না দেখে দালালের হাত ধরে ভারতে পাড়ি দেই। এরপর স্বামী, ছয় ছেলে ও তিন মেয়েসহ হায়দরাবাদ রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় পেয়েছিলাম। সাড়ে ৫ বছর সেখানেই থেকেছি। এরই মধ্যে একে একে তিন মেয়ে ও পাঁচ ছেলের বিয়ে দিয়েছি। ক্যাম্পের বাইরে কাজকর্ম করে রোজগার করে ভালোই চলছিল জীবন। কিন্তু সম্প্রতি ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। এমনকি দুই দফায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। তাই ঠিক করলাম এখানেও আর থাকা যাবে না। এখানে থাকলে ভারত সরকার একদিন আমাদের মিয়ানমারের হাতে তুলে দেবে। তাই দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসার চেষ্টা শুরু করলাম।’
ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার প্রক্রিয়া সম্পর্কে এই রোহিঙ্গা নারী আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের যাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে আসাই নিরাপদ মনে হলো। তাই অনেকের মতো আমরাও ভারতের দালালদের শরণাপন্ন হলাম। প্রতিজন ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে রাতের অন্ধকারে সীমান্তের দিকে রওয়ানা দিলাম। এক পর্যায়ে মনিপুর সীমান্তে পৌঁছাই। এরপর দালালরা আমাদের বাংলাদেশের পথ দেখিয়ে দিয়ে সটকে পড়ে। ভোররাতে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে অন্যান্যরা ঠিকভাবে চলে গেলেও আমি ধরা পড়ে যাই। ভারতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আমাকে মারধর করে। তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পরে বিএসএফ সদস্যরা আমাকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। পরের দিন বাংলাদেশে ঢুকে ওই সীমান্তে আমার সন্তানদের খোঁজ করার চেষ্টা করি এবং স্থানীয় বাংলাদেশিদের সহায়তায় পেয়েও যাই। পরে বিভিন্নভাবে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে এসে পৌঁছাই।’
নিরাপত্তা পেলে মৃত্যুর আগে রাখাইনে ফেরার আশা প্রকাশ করে মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘মরার আগ পর্যন্ত রাখাইনে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন বেঁচে থাকবে আমার। কারণ রাখাইন আমার দেশ, আমার বাপ-দাদার ভিটে রয়েছে সেখানে। রাখাইনের কবরে শুয়ে আছে আমার স্বজনরা।’
ভারত থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের প্রসঙ্গে কক্সবাজার ত্রাণ, শরণার্থী ও পুনর্বাসন (আরআরসি) কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, ‘নতুন বছরের শুরু থেকে প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের প্রথমে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)-এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। পর্যায়ক্রমে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।’ কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে এখন প্রায় দেড়শ’ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-