মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার ভার, মরণনেশা ইয়াবার ভয়াল থাবা এবং মানবপাচারকারীদের দৌরাত্ম্য—এই তিন কারণে ‘কুপোকাত’ বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতের জেলা কক্সবাজার। অথচ পাহাড়-সাগরঘেঁষা ও ইতিহাসসমৃদ্ধ কক্সবাজার ঘিরেই সরকার বাস্তবায়ন করছে কয়েকটি মেগা প্রকল্পসহ অন্তত তিন লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প।
যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর কক্সবাজার হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক ও পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ জেলার একটি।
কক্সবাজার ঘিরে সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ, মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপন, এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড, দোহাজারী-ঘুনধুম রেললাইন নির্মাণ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্প, এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌবাহিনীর সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ, সাবরাং এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক জোন, মহেশখালীতে চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, জালিয়ার দ্বীপ এক্সক্লুসিভ ‘নাফ ট্যুরিজম পার্ক’, হাইটেক পার্ক ও জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন। এ ছাড়া শিগগিরই সরকার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু করতে পারে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ও প্রক্রিয়াধীন।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের পুনঃসম্ভাব্যতা যাচাইও প্রক্রিয়াধীন।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর কক্সবাজার আক্ষরিক অর্থেই পাল্টে যাবে—এমনটা বিশ্বাস করে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু তারা এটাও মনে করছে, প্রাণ রক্ষার্থে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উন্নয়নকে বিঘ্নিত করার পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ‘হুমকি’ হয়ে উঠতে পারে।
এ ছাড়া দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর মাদকদ্রব্য ইয়াবা ট্যাবলেট। আর কর্মক্ষম যুবসমাজের আরেকটি অংশকে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই কক্সবাজার দিয়ে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশে। এসব কারণে কক্সবাজার ঘিরে যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে সেটা ম্লান হয়ে যেতে পারে বলে মনে করে তারা।
দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে ব্যবসা করেন আইএমএস গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার আবু। হোটেল সি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান আবুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজার ঘিরে বর্তমান সরকার যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কক্সবাজার অর্থনৈতিকভাবে পাল্টে যাবে। চট্টগ্রামের পরই সর্বাধিক অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পরিণত হবে কক্সবাজার। এর সঙ্গে পর্যটনকেন্দ্রিক সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হওয়ার পর দেশের পর্যটন খাতে আমূল পরিবর্তন আসতে বাধ্য। কিন্তু এমন সম্ভাবনাময় কক্সবাজারে এখন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণনেশা ইয়াবা। যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ইয়াবা। বলা হচ্ছে কক্সবাজার ইয়াবার প্রবেশদ্বার। তাই কক্সবাজারের এই দুর্নাম অবশ্যই ঘোচাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মানবপাচারকারীদের অপতৎপরতার কারণেও কক্সবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট তো আছেই।’
একই আশঙ্কার কথা বললেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকাও। কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার জাতীয় পর্যায়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পরিণত হবে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও পর্যটনশিল্পে কক্সবাজার আশাতীত সাফল্য পাবে—এটা আমরা ব্যবসায়ীরা বিশ্বাস করি। কিন্তু এখন কক্সবাজার নাম শুনলেই দেশের মানুষের সামনে চলে আসে ইয়াবা, মানবপাচার ও রোহিঙ্গা সংকটের
বিষয়টি। এটা কক্সবাজারের জন্য মারাত্মকভাবে নেতিবাচক।’ তিনি সরকারের কাছে কক্সবাজারকে মাদক ও মানবপাচারকারী মুক্ত করা দাবি জানান। সেই সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করার আহ্বান জানান তিনি। না হলে কক্সবাজার ঘিরে সরকারের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাফল্য আসবে না বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
আবু মোরশেদ আরো বলেন, ‘কক্সবাজার ঘিরে যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নাধীন আছে, সেখানে প্রচুর জনবল দরকার। সেই জনবলের চাহিদার যতটা সম্ভব কক্সবাজার থেকে পূরণ করা জরুরি। কারণ কর্মসংস্থান হলে মানুষের অপরাধপ্রবণতা কমে যায়।’
একই বিষয়ে কক্সবাজার বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের মহাপরিচালক এম এম সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইয়াবা, রোহিঙ্গা ও মানবপাচার—এই তিন কারণে কক্সবাজার এখন বিপদগ্রস্ত। তবে এ সমস্যা শুধু কক্সবাজার জেলার সমস্যা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই আমি মনে করি, এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের আরো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, কক্সবাজার ঘিরে সরকার যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলছে। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট কোনো ঝামেলা নেই। তবে ইয়াবা, মানবপাচার ও রোহিঙ্গা ইস্যু কক্সবাজারের দুর্নাম বয়ে আনছে। এই দুর্নাম ঘোচাতে সরকার কাজ করছে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, যদি মাদকের থাবা বন্ধ করা না যায়, তাহলে কক্সবাজারের দুর্নাম বাড়বে। তাই এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে মাদক পাচারকারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। মানবপাচারকারীদের দৌরাত্ম্যও কমে এসেছে। আর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরকার কাজ করছে। তাই কক্সবাজারের উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব পড়বে না।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে রোহিঙ্গা, মাদক ও মানবপাচার—এই তিনটির খুব বেশি যোগসূত্র নেই বলে দাবি করেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কক্সবাজারে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আক্ষরিক অর্থেই বদলে যাবে কক্সবাজার। এর পরও জেলায় রোহিঙ্গা, মাদক ও মানবপাচারকারীদের সৃষ্ট সমস্যা আছে। এটা মোকাবেলায় সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্যোগ নিয়েছে।’
/কালেরকন্ঠ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-