ডেস্ক রিপোর্ট : ১২৯ বছরের স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে রেলপথে কক্সবাজার। এরপর ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যখন সংযোগ ঘটবে তখন ট্রেনে চেপেই পৌঁছানো সম্ভব হবে মিয়ানমার পেরিয়ে চীন। চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। এখন দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন ঘুনধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হবে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে ৬ হাজার ৩৪ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিলে এবং বাকি ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই রেলরুটে দ্রুতগতির ট্রেন চলাচলের উপযোগী ডুয়েল গেজ রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মিত হবে। প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলা বান্দরবান রেলপথে যুক্ত হবে। এ যাবৎ কাজের অগ্রগতি প্রায় ২৮ শতাংশ।
সবকিছু ঠিকঠাক মতো এগিয়ে গেলে আর মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে আগামী ২০২২ সালে পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতপানে ছুটবে যাত্রীবাহী ট্রেন। চট্টগ্রাম থেকে অপরূপ প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে করতে মাত্র দেড়-দুই ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হবে কক্সবাজার শহরে। সেখানে সৈকতের কাছাকাছি ‘মুক্তার ধারক ঝিনুকে’র মডেলে নির্মিত হবে দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন। একে ঘিরে গড়ে তোলা হবে শপিং কমপ্লেক্স, অভিজাত হোটেল-মোটেল, বাণিজ্যিক ভবন ও বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবন। এর ফলে পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠবে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ এবং তার বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সৈকতনগরী কক্সবাজার।
অর্থনীতিবিদদের অভিমত, সমগ্র কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত বা বেলাভূমি ও এর সংলগ্ন পাহাড়-টিলা, বন-জঙ্গল, সমতল ভূমি অবৈধ দখলবাজদের কব্জা থেকে কঠোরহাতে পুনরুদ্ধার, দূষণরোধ, আইন-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা ও সৈকত সংরক্ষণের জন্য নিবিড়, সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। কেননা দেশে বিশেষ করে কক্সবাজারে পর্যটন শিল্প বিকাশের পথে এগুলো বড় বাধা।
কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ সম্পন্ন হলেই ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের পথে এক ধাপ দেশ এগিয়ে যাবে। তাছাড়া কক্সবাজার-ঘুনধুম পর্যন্ত মহাসড়ক সম্প্রসারণ করে এর আরো বিস্তৃতি ঘটবে। যা মিয়ানমার হয়ে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং সিটির সঙ্গে আন্তঃদেশীয় মহাসড়কপথে সংযুক্ত করবে বাংলাদেশকে। মহাসড়কের কাজ শুরু হয়ে আপাতত থমকে আছে। তবে কর্তৃপক্ষ জানায়, ফের কাজ চালু হবে। এরফলে পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে পূর্বে চীন অবধি ঐতিহাসিক সেই ‘সিল্ক রুট’ হবে পুনরুজ্জীবিত।
এরফলে জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যকার পূর্বমুখী (লুক ইস্ট) অর্থনৈতিক কূটনীতির দুয়ার খুলে যাবে। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজতর হয়ে উঠবে। কৃষি-খামার ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত এবং রফতানি সুবিধার প্রসার ঘটবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনসাধারণের কর্মচাঞ্চল্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম ডুয়েল গেজ রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকার। ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণের ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষও সরাসরি ট্রেনে কক্সবাজার যেতে পারবেন। গত ২৩ জানুয়ারি সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ৩৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্ট ঢাকা’কে উক্ত প্রকল্পের কাজ দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। উক্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৈঠক শেষে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, কক্সবাজারে ট্রেনে অতিদ্রুত যাওয়া সম্ভব হবে। আর কোনো সমস্যা নেই। আমাদের মূল সমস্যা ছিল ভূমি অধিগ্রহণ। এখন প্রয়োজনীয় জমি আমরা পেয়েছি। কাজও শুরু হয়ে গেছে। ২০২২ সালে এ প্রকল্প শেষ করার কথা রয়েছে। নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের দোহাজারী রেলপথকে এখন দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। আবার রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত আরেকটি রেললাইন নির্মাণের কাজও চলছে। যা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে সরাসরি ট্রান্স-এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করবে। মেগাপ্রকল্পের ডিজাইনে পরিবর্তন এবং ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে শুরুর দিকে কাজে স্থবিরতা ছিল। এখন গতি এসেছে। প্রকল্পের জন্য মোট এক হাজার ৪শ’ একর জমি অধিগ্রহণ করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত চার ভাগের একভাগ আয়ত্তে আসার সাথে সাথে প্রকল্পের ফিজিক্যাল কাজও এগিয়ে চলেছে।
১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম লটে দোহাজারী-রামু রেলপথ এবং দ্বিতীয় লটে রামু-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয় গতবছর মার্চ ও জুলাই মাসে। রেলপথ নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে যৌথভাবে চীনের দু’টি এবং বাংলাদেশের দুই প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম-দোহাজারী ভায়া ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে বান্দরবানের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের মধ্যদিয়ে হয়ে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরে সংযুক্ত হওয়ার পথে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে গেল। চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজে রয়েছে ৯টি নতুন রেলস্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট ব্রিজ, ১৪৯টি কংক্রিট বক্স কালভার্ট, ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট (পাইপ কালভার্ট)। ঘণ্টায় একশ’ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন রেললাইনে অত্যাধুনিক অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা সংযোজন করা হচ্ছে। কক্সবাজার সৈকতে ঝিনুকের আদলে অত্যাধুনিক রেলস্টেশন কমপ্লেক্স নির্মিত হবে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য সোয়া একশ বছর আগে ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শত বছর পার হলেও এই রেলপথ নির্মাণের মূল কাজ শুরুই হয়নি। এ দীর্ঘকালে দফায় দফায় চলে সমীক্ষা। ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম-দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা অনুসারে কক্সবাজার পর্যন্ত বাদবাকি অংশে রেলপথ তৈরি হয়নি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ স্থাপনে জন্য ২০১০ সালে প্রথম প্রকল্প নেয়া হয়। সফল পরিকল্পনা মন্ত্রী, বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের হাত ধরে যার বাস্তব রূপায়ন ঘটছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-