শাহীন মাহমুদ রাসেল ::
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত কক্সবাজার-টেকনাফের দেড় শতাধিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন। ১৬ ফেব্রুয়ারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এইসব ইয়াবা পাচারকারীরা আত্মসমর্পণ করবে বলে খবর পাওয়া গেছে। স্বেচ্ছায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আগ্রহী এসব ইয়াবা কারবারিদের ডাকে সাড়া দিয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহল। দীর্ঘদিন এ ব্যবসা থেকে অর্জন করা অর্থের মায়া ভুলে দেড় শতাধিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি ইয়াবার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর এই অভিযানে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি’র সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবা পাচারকারীদের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এরপর অনেক ইয়াবা পাচারকারী স্বপ্রণোদিত হয়েই আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অনেকেই ইতোমধ্যে আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকেও ফিরে এসেছে।
মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা এখন ‘বিষফোঁড়া’য় রূপ নেয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ নেমেছে। সারা দেশে একযোগে চলছে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান। চলমান অভিযানে প্রতিদিনই ধরা পড়ছে মাদকের ছোটবড় চালান। এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্যভাবে আটক হচ্ছে ইয়াবার চালান। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে ‘ক্রসফায়ারে’ মাদক চোরাকারবারি নিহতের ঘটনাও ঘটছে। ‘ক্রসফায়ার’ থেকে প্রাণ বাঁচাতে টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারের ইয়াবা কারবারিদের একটি অংশ ‘আত্মসমর্পণ’ করতে পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে গিয়েছে।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, দেড় শতাধিক জন রয়েছেন নিরাপত্তা হেফাজতে। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণের নির্ধারিত দিন পর্যন্ত এই তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে। তবে এত কিছুর পরও থেমে নেই ইয়াবা চোরাচালান। বিরাহমহীন অভিযান এবং আত্মসমর্পণের আয়োজনের মধ্যেই মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এখনো প্রতিদিনই ঢুকছে ইয়াবার চালান। প্রশ্ন উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘ তালিকা এবং আত্মসমর্পণের অপেক্ষায় থাকা মাদক কারবারিদের বাইরেও ইয়াবা কারবারিদের জাল কি অনেক দূর বিস্তৃত?
সর্বশেষ প্রাপ্ত সুত্রে জানা যায়, ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ দিন ধার্য করেছে। তবে কতজন আত্মসমর্পণ করবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ইয়াবা কারবারিদের অনেকেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে। বিশাল সীমান্ত এলাকায় অভিযান এবং আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে এই ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অনেকে। প্রতিদিন নতুন নতুন নাম যোগ হচ্ছে এই ব্যবসায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি সংস্থার সমন্বয়ে ও পৃথক অভিযানের মাধ্যমে ইয়াবা কারবারিদের রুখতে হবে, এমনটাই দাবী করেছেন সচেতন মহল।
জানা গেছে, ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল প্রধানমন্ত্রীর নজরে দিলে তিনিও এতে সম্মতি দিয়েছেন। এরপরই জেলা পুলিশ এ নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান অতিথি থাকবেন। এ ছাড়া বদির স্ত্রী সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার চৌধুরী, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। আত্মসমর্পণকারীদের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো মামলা রুজু হবে না। পুরনো মামলাগুলো তাদের আইনিভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের সুপথে ফিরতে সরকার সহায়তা করবে।
গত বছরের ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এ সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজারেই ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফে নিহতের সংখ্যা ৩৯ জন। তাদের ২৫ জন টেকনাফের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফের বাহারছড়া ঘাট এলাকায় র্যাব-৭ এর অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ইয়াবা কারবারি নিহত হয়।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। এরমধ্যে ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারি রয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকা ওই হালনাগাদ তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি এবং বদির ৩ ভাই, ১ বোন, ভাগ্নেসহ ২৬ জন আত্মীয়ের নাম রয়েছে। আরেক সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর স্বজনের নামও রয়েছে। আত্মসমর্পণ করতে চান ‘ক্রসফায়ারে নিহত’ অনেকের স্বজনও।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, র্যাব-পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান এবং ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনায় চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিরা আতঙ্কে আছেন। প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছেন। অনেকেই যোগাযোগ করেছেন আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির সঙ্গে। আত্মসমর্পণের তালিকায় রয়েছেন বদির ভাই, বোন, স্বজনসহ ঘনিষ্ঠরাও। এরমধ্যে পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে ‘কক্সবাজার পুলিশ লাইনে’ আছেন প্রায় ১২০ জন। তাদের স্বজনরা সেখানে গিয়ে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করছেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বদির আপন ভাই তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী আবদুল আমিন, আবদুর শুক্কুর, ফয়সাল রহমান, বদির বোন শামসুন্নাহার, ভাগ্নে শাহেদ রহমান নিপু, ফুপাতো ভাই শফিক রহমান, খালাতো ভাই মং মং চ্যাং। এ ছাড়াও আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলমের ছেলে দিদার, টেকনাফের নূরুল হক মেম্বার, জামাল মেম্বার, জাকারিয়া, একরামুল হক মেম্বার, মৌলভি রফিক উদ্দিন, শফিক আহমেদ, মৌলভি মজিবুর রহমান, মৌলভি আজিজ উদ্দিনসহ ১২০ জন। এরা সবাই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শেষ করেছেন বলে জানা গেছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-