কী হবে ইয়াবার বাবাদের ‘প্রাসাদের’?

আবদুর রহমান, বাংলা ট্রিবিউন :

ফাইল ছবি

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা চালানের বেশির ভাগই আসে কক্সবাজার জেলা হয়ে। তাই ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত ‘গডফাদারদের’(যারা স্থানীয়ভাবে ‘বাবা’ নামেও পরিচিত) অনেকের বাড়িই এই জেলায়। এদের কেউ কেউ ইয়াবা বিক্রি করে কোটিপতি বনে গেছেন; কিনেছেন অঢেল জায়গা-জমি, বানিয়েছেন বিলাসবহুল সব বাড়ি। মাদকের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরুর পর, কক্সবাজারের এসব ইয়াবা ‘সম্রাটদের’ অনেকেই ‘সেফহোমে’ আশ্রয় নিয়েছে। আবার কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এমতাবস্থায় এসব মাদক কারবারিদের সম্পদ ও বাড়ি-ঘর জব্দ করা হবে কি-না এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। পুলিশ বলছে, মাদক কারবারিদের সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত কেউ পার পাবে না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক ইয়াবা কারবারিরা এখন কক্সবাজারে পুলিশ হেফাজতে অন্তত ৭০ জনের মতো জড়ো হয়েছে। তারা একধরনের ‘সেফহোমে’ রয়েছে। দুবাই, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে এসে সেখানে অবস্থান করছে তারা। তাদের মধ্যে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির তিন ভাইসহ টেকনাফ উপজেলার ইয়াবা কারবারি রয়েছে অন্তত ৫০ জন। রয়েছে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও। তবে আত্মসমর্পণে ইচ্ছুকদের তালিকার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র মতে, ইয়াবার টাকায় দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল বাড়ি করেছেন তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী হ্নীলার লেদা এলাকার নুরুল হুদা, চকবাজার এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য সৈয়দ হোসেন, টেকনাফের কুলাল পাড়ার নুরুল বশর প্রকাশ নুরশাদ ও জালিয়াপাড়ার জোবাইর হোসেন। এরা সবাই ‘সেফহোমে’ রয়েছেন। এছাড়া পালিয়ে থাকা মৌলভীপাড়ার আবদুর রহমান মাদকের টাকায় গড়েছেন দামি ভবন। সদরে আলিশান বাড়ি গড়েছে শাহজান মিয়া, কুলার পাড়ায় বাড়ি বানিয়েছেন মোহাম্মদ কাদের। আবদুল আমিন, মোহাম্মদ আমিন ও নুরুল আমিনরা তিন ভাই মাদক পাচার করে ডেইলপাড়ায় তুলেছে দৃষ্টিনন্দন বাড়ি।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ইয়াবা চোরাচালানের টাকা দিয়ে বানানো এসব বিলাসবহুল বাড়ি ফেলে রেখে অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযানে সীমান্তের ৬০টির মতো বিলাসবহুল বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ, বিজিবি, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। এসময় ইয়াবা, কিরিচ ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
স্থানীয়রা জানান, ইয়াবার টাকায় যারা বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক-ব্যালেন্স ও জায়গা-জমি কিনেছে, এসবের কী হবে? সরকারের উচিত এসব অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা। তা না হলে আবারও তারা এই ভয়াবহ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ইয়াবার টাকায় শতাধিক আলিশান বাড়ি বানানো হয়েছে টেকনাফ সীমান্তে। এর মধ্যে ৬০টি বাড়ির মালিকের নাম আমাদের তালিকায় রয়েছে। তালিকার বাইরে থাকা ইয়াবা চোরাচালানির ৪০টি বিলাসবহুল বাড়ির তথ্য রয়েছে আমাদের কাছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তে তারা যেভাবে বাড়ি বানিয়েছে, এমন বাড়ি ঢাকার গুলশান-বনানিতেও দেখা যায় না। ওইসব বাড়ির জিনিসপত্র দেখে মনে হয় বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। এমনকি প্রবেশ পথ ও রান্নাঘরে পর্যন্ত ফ্যান লাগানো আছে। এগুলোকে রাজপ্রাসাদের মতো মনে হয়। তবে এগুলো আসলে ইয়াবাপ্রাসাদ। কারণ ইয়াবার টাকায় এসব বাড়ি বানানো হয়েছে।’
‘সেফহোমে’ গেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ একরাম। তিনি টেকনাফ শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মৌলভীপাড়ায় রাস্তার পূর্বে পাশে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়েছেন। এলাকার সবাই তাকে ‘বাবা’ নামে চেনেন। তবে সাবেক সংসদ আবদুর রহমান বদির আত্মসর্পণের ডাকে তিনি ‘সেফহোমে’ চলে যান। এর আগে তিনি মিয়ানমারে ছিলেন।
সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ জানান, একরামের আরেক ভাই আবদুর রহমান তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। তারা দুজনই টেকনাফের মৌলভীপাড়ার হাজী ফজল আহমদের ছেলে। তবে আবদুর রহমান এখন দুবাই অবস্থান করছে। তারা আরও জানান, ইয়াবা ব্যবসা করে সাত বছরে কোটিপতি হয়েছে মোহাম্মদ একরাম। সে টেকনাফের মৌলভীপাড়ার অন্যতম শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী। সে গ্রামের ঠিক পেছনে নাফ নদী দিয়ে মিয়ানমার থেকে নৌকায় করে ইয়াবার চালান এনে খালাস করতো এক সময়। তারপর সেই ইয়াবার চালান পৌঁছে দেওয়া হতো কক্সবাজার শহর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইয়াবা সরবরাহের জন্য তার রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। একরামের বাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ায় মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার গড়ে ওঠে ভালো সম্পর্ক। ইয়াবার টাকা ভাগবাটোয়ারার জন্য একরাম হোসেনের একটি চক্রও রয়েছে। ২০১১ সালের দিকে টেকনাফের একজন প্রভাবশালী ইয়াবা গডফাদারের নজরে পড়ে একরাম। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সাত বছরে ইয়াবা চোরাচালান করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছে সে। নামে-বেনামে শহরে দুটি ভবন, জমি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারসহ বিপুল পরিমাণ জায়গা-জমি ও সম্পত্তির মালিক হয়েছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই আমাদের নজরে আছে। মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হওয়ায় তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদাররা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। ইয়াবার টাকায় যারা রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়েছে, তাদের বাড়ি, গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালেন্সের তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে জড়িত কেউ রেহাই পাবে না।’
জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি আমরা। মাদকের টাকায় যারা অঢেল সম্পদ গড়েছে, তারা কেউই এখন স্বস্তিতে নেই। তারা কেউ রেহাই পাবে না। মাদক বন্ধ করতে যা যা করা দরকার আইনের মধ্যে থেকে আমরা তার সবই করবো।’

আরও খবর