মো. কামাল হোসেন
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন এবং তাঁর অবর্তমানে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ সন্তান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি কিংবদন্তি এই নেতার জন্ম ময়মনসিংহে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তি ছিল অসাম্প্র্রদায়িক চেতনা। সৈয়দ আশরাফ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার যোগ্য ধারক ও বাহক। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মানুষের জীবনে শান্তি আনতে পারে না, কোনো সমস্যাও দূর করতে পারে না—কথাটি তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায় উঠে আসত।
অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শিক্ষাজীবনে সফলতার সঙ্গে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং পিতার আদর্শে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব।
সৈয়দ আশরাফ তারুণ্যের শুরুতেই ১৯৭১ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রিয় মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাণপণে লড়াই করেছিলেন তিনি। নিজের জন্য কিছুই করেননি, জনগণের তরেই বিলিয়েছেন জীবনের সব কিছুই। বারবার মন্ত্রী হলেও প্রতিবছরই তাঁর সম্পদের পরিমাণ কমত বলে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও লোভহীন জীবন বেছে নেওয়ার ঘটনা উপমহাদেশের রাজনীতিতে খুবই বিরল। আশরাফুল ইসলাম সেই বিরল রাজনীতিবিদদের অন্যতম।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনস্থ যুবলীগের সদস্য ছিলেন। প্রবাসজীবনে যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনেও ছিলেন সক্রিয়।
১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে এসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৈয়দ আশরাফকে যখন যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন বিনা বাক্য ব্যয়ে, আন্তরিকতার সঙ্গে।
ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল গ্রেপ্তার হলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তাঁর যোগ্য কর্ণধার শেখ হাসিনার দুঃসময়ের সহযাত্রী, একজন নির্ভরযোগ্য ও আস্থাভাজন নেতা। শত বাধাবিপত্তির মধ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতেন। ২০০৭ সালের এক-এগারো পরবর্তী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার যে ষড়যন্ত্র তখন চলেছিল, তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। বলা যায়, তাঁর বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী নেতৃত্বের কারণে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আওয়ামী লীগ, নিরাপদ হয়েছিল বাংলাদেশ।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরে তাঁকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ির প্রতি ছিলেন উদাসীন তিনি। সরকারি বরাদ্দের প্লট নেননি, নেননি শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধাও। প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্ত্রী শীলা ইসলামের চিকিৎসাভার বহন করতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘বনানীর বাড়িটি বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছি তা দিয়েই চিকিৎসার খরচ হয়ে যাবে।’ ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও লোভহীন জীবন বেছে নেওয়ার ঘটনা উপমহাদেশের রাজনীতিতে খুবই বিরল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেই বিরল রাজনীতিবিদদের অন্যতম।
২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি দেশে না থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন। গত ৩ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে ৬৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও গৌরবময় নেতৃত্ব চির অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলার মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করবে। তাঁর অকাল প্রস্থানে মনের অজান্তে চোখের কোণে জমা হয়েছিল জল। জানি না কেন?
লেখক : জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-