আবদুর রহমান, বাংলা ট্রিবিউন :
মাদক বহনকারী’ থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে বসবাসকারী শরণার্থী রোহিঙ্গারা। কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ইয়াবাসহ শরণার্থীদের আটকের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, কিশোর ও পুরুষরা। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবা কারবারিদের তালিকায়ও রয়েছে ১৩ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম। তবে এই তালিকায় স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি। এদিকে রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, ইয়াবা গডফাদারদের অধিকাংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ট বা তাদের স্বজন।
মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাড়ার পর মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি ‘উত্তেজক বড়ি’ ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী ধরা পড়েছে। এসব মামলায় তিন বছরে ৫ হাজারের বেশি আসামি ধরা পরেছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া। ইয়াবা মজুতের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে জনবহুল ওই ক্যাম্পগুলো। এমনকি অনেক ইয়াবা কারবারিও সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবেই টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসা ও পাচার বেড়ে চলছে। শুধু একটি ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসা ও পাচারে জড়িত ৮০ জনের নাম স্থানীয় আনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছে বলে এক রোহিঙ্গা নেতা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই রোহিঙ্গা নেতা জানান, ‘গত বছরে ৩১ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে লেদার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা প্রহরী মোহাম্মদ আবু ইয়াছেরকে (২২) বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ইয়াবা-সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।’
মাদক বহনকারী হিসেবে কাজ করতে করতে এখন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত এমন এক রোহিঙ্গা (নাম না বলার শর্তে) জানান, অভাবের তাড়নায় ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়েছে তার সতের বছর বয়সী ছেলে। তিনি বলেন, ‘এক সময় স্থানীয় এক ইয়াবা কারবারি তার ইয়াবার চালান আমার ছেলের ঘরে মজুদ রাখতো। এর বিনিময়ে তিন হাজার টাকা নিতাম। পরে কিছুদিন পর ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খুচরা ইয়াবা কিনে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বিক্রি করতে শুরু করে আমার ছেলে।’
তিনি জানান, ‘এক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামে ইয়াবার একটি চালান তার পার্টনারকে দিতে গিয়ে ছেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায় আমার ছেলে।’
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মতলব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক সময় অভাবের তাড়নায় রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ে এই কথা সত্য। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এ কাজে তাদের ব্যবহার করেছে। তবে অনেক রোহিঙ্গা এখন খুচরা ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এমন খবর পেয়েছি।’
রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে একমত পোষণ করে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, ‘চলতি মাসে ১৫ জনের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে ইয়াবা পাচার বেড়েছে। কিছু স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী রোহিঙ্গাদের এ কাজে জড়াতে সহায়তা করছে, এমন তথ্য আমরাও পেয়েছি। তবে এখন অনেক রোহিঙ্গা এই ইয়াবা ব্যবসা জড়িয়ে পরেছেন। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ‘ইয়াবার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কেউ রেহাই পাবে না। সরকারের নির্দেশে ইয়াবা বিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমাদের তৎপরতার কারণে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। এই মরণ নেশা ইয়াবা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’
এদিকে মাদক ব্যবসায় রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে র্যাবের জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-৭) টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহতাব। তিনি বলেন, ‘দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর স্থানীয় অনেক ইয়াবা পাচারকারীও রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। যে কারণে শিবিরগুলোয় আমাদের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। ইয়াবা বন্ধ করতে সীমান্তে র্যাব সদস্যরা জীবন বাজি রেখে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।’
নাফ নদীর তীরে বিজিবির টহল (ছবি: সংগৃহীত)
পুলিশের ভাষ্য মতে, গত এক বছরে কক্সবাজারের নতুন আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ও নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ১৮ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। এ ঘটনায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২৩৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাদক মামলা ৬৮টি, ৬টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। বাকিগুলো ডাকাতি, মারামারি, চুরি ও চোরাচালানসহ অন্যান্য। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ১২২ জন।
এদিকে চলতি বছরে (২৪ জানুয়ারি) বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কক্সবাজারে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ১৪ জন মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে চারজনই রোহিঙ্গা বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি মিয়ানমার থেকে ইয়াবার একটি বড় চালান নিয়ে টেকনাফের হ্নীলা নাফনদ দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার সময় বিজিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়। এর আগে ৫ জানুয়ারি সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে দুই রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় বিজিবি-পুলিশ তাদের কাছ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গত তিন বছরের (২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের আসার পর শরণার্থী অধ্যুষিত কক্সবাজার জেলায় ইয়াবা আটকের পরিমাণ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়ে গেছে মাদক মামলা ও আসামি গ্রেফতারের সংখ্যাও। ২০১৬ সালে টেকনাফ উপজেলা থেকে উদ্ধার করা ইয়াবার মোট পরিমাণ বলা হয় দেড় কোটি। ২০১৭ সালে উদ্ধার করা ইয়াবার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটিতে। আর ২০১৮ সালে এই পরিমাণ আড়াই কোটি ছাড়িয়ে যায়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-