সাহাদাত হোসেন পরশ :
‘দুইবারের এমপি ছিলাম। কিন্তু মনের কথা কাউকে বলতে পারিনি। সামনে নির্বাচন ছিল। ভোটের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে। নির্বাচনের পর এখন সেই দুর্বলতা নেই। আমাকে নিয়ে যে বদনাম, নির্বাচন সামনে রেখে তা সহ্য করে পথ চলেছি। এখন কলঙ্ক ঘোচাতে চাই। টেকনাফকে ইয়াবামুক্ত করবই। এর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত রয়েছি।’ কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি গতকাল শুক্রবার সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের একটি উদ্যোগ নিয়ে এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে সরকার। স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক ইয়াবা কারবারিরা এখন কক্সবাজারে পুলিশের হেফাজতে ‘সেফহোমে’ রয়েছেন। সেখানে অর্ধশতাধিক ইয়াবা কারবারি রয়েছেন। তাদের মধ্যে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির তিন ভাইসহ অনেক নিকটাত্মীয় আছেন। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরুর পর নানাভাবে আলোচনায় আছেন বদি। অনেকের মধ্যে এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে, তাহলে কি বদলে যাচ্ছেন বদি? এসব প্রশ্ন নিয়েই বদির মুখোমুখি হয় সমকাল।
কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীর ১ হাজার ১৫১ জনের তালিকায় ৭৩ প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারিকে (গডফাদার) চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকায় সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদিসহ ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি এবং বদির ৫ ভাই, ১ বোনসহ ২৬ জন নিকটাত্মীয়ের নাম রয়েছে। তালিকায় নাম থাকা, ইয়াবা প্রতিরোধের পরিকল্পনার ব্যাপারে সমকালের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।
আবদুর রহমান বদি বলেন, ইয়াবা নিয়ে সংসদে বক্তব্য দিয়েছি। সেখানে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছি, বাংলাদেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন বলতে পারবে না কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ীর জন্য কখনও তদবির করেছি। আমার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। এসব রিপোর্টের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত করেছে। তারা তদন্তের পর বলেছে, ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। এরপরও দুটি মিডিয়ায় আমার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন লিখছে। কারণ তাদের সঙ্গে আমার মামলা রয়েছে। ওই মামলা এখন হাইকোর্টে স্থগিত।
বদি বলেন, টেকনাফের ইয়াবা ব্যবসা প্রতিরোধের ডাক দিয়েছি। ইয়াবা কারবারিদের বলেছি, আত্মসমর্পণ করুন। যদি না করেন তাহলে টেকনাফ ছেড়ে চলে যেতে হবে। ইয়াবার জন্য আমাকে কলঙ্কিত হতে হয়েছে। কলঙ্ক মোছার জন্য আমাকে এটা করতেই হবে। আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই সুপথে ফিরে এসেছেন।
কেন এ সময়টা বেছে নিয়েছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেক আগেই আমি এ প্রক্রিয়া শুরু করতে চেয়েছি। যদি ভোটের মধ্যে করতাম, তাহলে সবাই আমার ক্ষতি করে ফেলত। টার্গেট ছিল ইয়াবা প্রতিরোধে এ সময় বেছে নেব।
আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় কীভাবে যুক্ত হয়েছেন- এ প্রশ্নে বদি বলেন, কারও চাপে নয়, বিবেকের তাড়নায় এ কাজে যুক্ত হয়েছেন।
বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় ইয়াবা কারবারিদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আপনার নাম রয়েছে- এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানসিকভাবে আমাকে দুর্বল করার জন্য প্রশাসন, ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকরা মিলে এ ধরনের তালিকায় আমাকে যুক্ত করেছে। যারা ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে, তারাও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ইয়াবা কারবারিদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তালিকায় নাম থাকার কারণে কি এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, দুদকের মামলায় আমার তিন বছরের সাজা ছিল। এ কারণে আমি নির্বাচন করতে পারিনি। আমার সহধর্মিণীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সে এমপি হয়েছে।
বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় আপনার পাঁচ ভাইসহ ২৬ জন নিকটাত্মীয়ের নাম রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? জানতে চাইলে বদি বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ইয়াবার মামলায় হাজার হাজার আসামি গ্রেফতার হয়েছে। কোনো আসামি কি বলেছে, জব্দ ইয়াবা আমার ভাইদের কাছে নিয়ে এসেছে? আমার ভাইবোনদের নামে অন্য গ্রামেও লোকজন রয়েছে। সেখানে টাকা-পয়সা দিয়ে বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তন করে আমার ভাইবোন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অহেতুক মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে আপনি ও আপনার স্বজনদের জড়াবে- এ প্রশ্নে বদি দাবি করেন, যেসব গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন টেকনাফে ছিল তারা কিন্তু সরকারের এন্টি। তার জনপ্রিয়তায় রোষান্বিত হয়ে তারা এমন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তার নাম যুক্ত করেছে। তাদের একটা লক্ষ্য ছিল, যাতে তিনি নির্বাচন করতে না পারেন। প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত লোকজনকে এ কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া এর সঙ্গে টেকনাফে দলীয় কোন্দলও জড়িত।
ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় আপনার ভূমিকা অনেকে সংশয়ের চোখে দেখে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন আমার একটাই চ্যালেঞ্জ, ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করতেই হবে। যারা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত, তাদের অনুরোধ করেছি ইয়াবা ব্যবসা ছেড়ে দিতে।
কেন ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে বদি বলেন, ‘কারণ এটার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন রয়েছে। প্রশাসনের লোকেরা কে কত টাকা খাইতেছে, সেটাই প্রশ্ন। সেটা বন্ধ না হলে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হবে কীভাবে? এটা বন্ধ করতে হলে আর্থিক লেনদেনের হিসাব বন্ধ করতে হবে। মূল সমস্যাটা ওখানেই।’
আপনার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে নেতিবাচক ধারণা সেটা মোকাবেলা করে কীভাবে সামনে এগোবেন- এ ব্যাপারে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে যদি আমার জীবন বিসর্জন দিতে হয় তাহলে আমার কোনো আফসোস নেই। সেটার জন্য আমি প্রস্তুত। যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাদের রক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তিন কনসেপ্ট নিয়ে এগোচ্ছেন। তা হলো- দুর্নীতি, মাদক ও জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ। এ তিন ব্যাপারে কোনো মার্সি নেই। অনেকে ভারত, মিয়ানমার, দুবাই ও সৌদি আরবে ছিল। তাদের সবাইকে বলেছি, তোমরা চলে আসো। আগে আমার ভাইদের সবাইকে সারেন্ডার করাব। অন্যরা সারেন্ডার করবে আর আমার ভাইয়েরা দূরে আরামে থাকবে, তা হবে না। গত দশ দিনের হিসাব নেন। টেকনাফ হয়ে কী সংখ্যক ইয়াবা ঢুকেছে। সেটা জানলে বুঝবেন, ইয়াবা রোধে আমি কী করতে চাচ্ছি।
কক্সবাজারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একরাম নিহত হয়েছে। তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? অনেকের অভিযোগ, আপনার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। এ ব্যাপারে বদি বলেন, একরামের মা-স্বজন আছেন না। তাদের জিজ্ঞেস করুন। একরাম ছিল আমার ছোট ভাইয়ের মতো।
ইয়াবা ব্যবসা বন্ধে প্রশাসনের প্রতি আপনার কী বার্তা থাকবে- এমন প্রশ্নে বদি বলেন, শুধু ইয়াবা ধরলে হবে না। ইয়াবার সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের ধরতে হবে। নেপথ্যে যারা রয়েছে তাদের জামাইয়ের মতো রাখলে হবে না। কারণ তারা অনেক টাকার মালিক। ইয়াবা ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রাক্ট হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব ঘটনার প্রকৃত তদন্ত না হবে, ততক্ষণ ইয়াবা কারবার বন্ধ হবে না। ইয়াবার কি হাত-পা রয়েছে? তা হেঁটে হেঁটে মিয়ানমার থেকে চলে আসবে? কিছু সংস্থা আছে, তারা ইয়াবার চালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি খুঁজে পান না। আপনি ইয়াবা ধরলেন। মিডিয়ায় তা প্রকাশ করে বাহ্বা নিলেন- শুধু এটা করলে ইয়াবার কারবার বন্ধ হবে না। ইয়াবা ধরার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের লোকটাকে অবশ্যই শনাক্ত করতে হবে। ইয়াবার মূল উৎসস্থল বন্ধ করতে হবে।
ইয়াবা ব্যবসা বন্ধে টেকনাফের বর্তমান এমপি হিসেবে আপনার স্ত্রী এরই মধ্যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আপনাকে শোধরাতে হবে, এমন চাপ কি আপনার স্ত্রী দিয়েছেন? এই প্রশ্নে বদি বলেন, যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় ইয়াবা বন্ধ করতে হয় সেভাবেই আমরা স্বামী-স্ত্রী কাজ করব। আমার স্ত্রীকে কেন আমাকে শোধরানোর জন্য চাপ দিতে হবে। আমার কি বিবেক নেই? কেউ কি তার স্ত্রীর কাছে ছোট হতে চায়। অন্যায় করলে আপনি আপনার বিবেকের কাছে ঘুমাতে পারবেন? ছেলেমেয়েদের কাছে অন্যায়ের প্রতীক হিসেবে থাকলে কখনও ঠিকভাবে ঘুমাতে পারবেন না।
অনেকের আশঙ্কা আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাঘববোয়াল ‘ক্লিন চিট’ পেয়ে যেতে পারেন। এ ব্যাপারে বদির দাবি, এটার সুযোগ নেই। যারা ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তারা প্রকৃত অর্থে গডফাদার। আবার কেউ আছেন তাদের ঘরে চাল কেনারও টাকা নেই তাদের গডফাদারের তালিকায় রাখা হয়েছে। হ্নীলার চেয়ারম্যান আনোয়ারের কথা ধরুন। তার সম্পর্কে সবাইকে খোঁজ নিতে অনুরোধ করব। তাকেও ইয়াবার গডফাদারের তালিকায় রাখা হয়েছে। এমন অনেকে আছেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের যারা ইয়াবা ব্যবসা করছে গডফাদারের তালিকায় তাদের কারও নাম নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইয়াবা কারবারিদের তালিকা তৈরি করেছে। তারা নিজেরা যাচাই-বাছাই করেনি। তারা প্রকৃত তথ্য নেয়নি।
ইয়াবার উৎসস্থল মিয়ানমারের ইয়াবার কারবারিদের সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা রয়েছে কি-না- এ প্রশ্নে বদি বলেন, ইয়াবা কারবারের সঙ্গে মিয়ানমারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত। বিশেষ করে তাদের সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)।
আপনি কী ধরনের ব্যবসা করছেন। আপনার আয়ের উৎস কী? অনেকে অনেক কথা বলতে চান। এ ব্যাপারে আবদুর রহমান বদি বলেন, বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের মধ্যে কতজন রয়েছেন তিনি তার নিজ এলাকার সেরা করদাতা। সেটার খোঁজ নিন। তিনবার কক্সবাজার জেলার সেরা করদাতা আমি। কর না দিলে সরকার কি সেরা করদাতার গেজেট করে? ইয়াবার কি কোনো কর রয়েছে? প্রথম কথা হলো, আমি একজন আমদানিকারক। বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঠ, খাদ্যসামগ্রী আমদানি করে থাকি। এ ছাড়া পৈতৃকভাবে আমার চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছের বড় খামার রয়েছে। স্ত্রী, দুই সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবার। বাকি জীবন সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। এত অর্থ-বিত্ত দিয়ে কী হবে।
/সমকাল
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-