রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ঘিরে জমজমাট ইয়াবা ব্যবসা

ডেস্ক রিপোর্ট – বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে শরণার্থী অধ্যুষিত জেলা কক্সবাজারে ইয়াবা আটকের পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। তবে গ্রেপ্তার হলে পরিচয় লুকানোর কারণে মাদক সংক্রান্ত মামলায় আটক রোহিঙ্গাদের সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

চলতি বছরের ৪ থেকে ১২ জানুয়ারি নয় দিনে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত নয় মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে চারজনই রোহিঙ্গা বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাড়ার পর মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি ‘উত্তেজক বড়ি’ ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী ধরা পড়েছে।

কক্সবাজার আদালতের তথ্য অনুযায়ী, এসব মামলায় তিন বছরে যথাক্রমে ৮০৯, এক হাজার ৯১৮জন ও দুই হাজার ২৭৮ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মমতাজ আহমদ বেনারকে বলেন, “গত দুই-তিন বছরে জেলায় যেসব মাদকের মামলা হয়েছে, তার কমপক্ষে ৬০ ভাগের অভিযুক্ত রোহিঙ্গা। টেকনাফ ও উখিয়ার মামলাগুলোর ক্ষেত্রে তাদের সংশ্লিষ্টতার হার আরো বেশি।” 
“তবে রোহিঙ্গারা আটক হলে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে নিজেদের বাংলাদেশি দাবি করে মিথ্যে নাম-ঠিকানা জানায়। ফলে মামলাগুলো ‘রেকর্ড’ হয় ভুয়া আসামির নামে,” বেনারকে বলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সৌমেন মণ্ডল।

এ বক্তব্যের সতত্যা নিশ্চিত করে পিপি মমতাজ বলেন, “এ কারণে বেশিরভাগ মামলায় আসামিদের ‘ভ্রাম্যমাণ’ দেখিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করতে হয়। যার ফলে মামলাগুলো যথাসময়ে নিস্পত্তি করাও সম্ভব হচ্ছে না।”

পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গত তিন বছরের (২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের আসার পর শরণার্থী অধ্যুষিত কক্সবাজার জেলায় ইয়াবা আটকের পরিমাণ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়ে গেছে মাদক মামলা ও আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যাও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছরের তুলনায় পরের বছর প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার বা আসামি গ্রেপ্তারের তথ্য পাওয়া গেছে।

“মামলার পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়, রোহিঙ্গারা আসার পর মাদক চোরাচালান আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গত তিন বছরে যথাক্রমে ২০ হাজার ৩০৬, ৮৫ হাজার ৫৭৮ এবং চার লাখ ৭১ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছেন মাদক কর্মকর্তারা,” বেনারকে বলেন সৌমেন মন্ডল।

এর আগে “বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে মানব পাচার, মাদকদ্রব্য চোরাচালানসহ সংঘবদ্ধ অন্যান্য অপরাধের ঝুঁকি বেড়েছে,” বলে গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে মন্তব্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রতি বছর বাড়ছে

কক্সবাজার আদালত পুলিশের পরিদর্শক কাজী মো. দিদারুল আলম বেনারকে জানান, টেকনাফ, উখিয়া, রামু, সদরসহ জেলার আট উপজেলায় ২০১৬ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে এক হাজার ১২৫ জনকে আসামী করে ৬৬৯টি মামলা হয়েছে।

তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এ ধরনের মামলার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ১৩৭। মোট মামলা হয় এক হাজার ৬৮৮টি।

২০১৮ সালের তথ্য দিয়ে পুলিশ পরিদর্শক বলেন, ওই বছর দুই হাজার ৮৮৯ জনকে আসামি করে এক হাজার ৮২৪টি মামলা হয়েছে।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, ২০১৬ সাল অধিদপ্তরের দায়ের করা ১৫৬ মামলায় অভিযুক্ত ১৬৪ জনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৬২ জন।

একইভাবে ২০১৭ সালের ২৫১ মামলায় অভিযুক্ত ২৬৫ জনের মধ্যে ২৬০ জন এবং ২০১৮ সালের ৩০৩ মামলায় অভিযুক্ত ৩৭২ জনের মধ্যে ৩২৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।

এর আগে গত বছরের শেষ তিন মাসে কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩৭ মাদক ব্যবসায়ী, যার মধ্যে ২৭ জনই মারা গেছেন টেকনাফে। তবে এদের মধ্যে রোহিঙ্গা কজন তা নিশ্চিত করতে পারেনি র‍্যাব–পুলিশ।

ইয়াবা ব্যবসায় রোহিঙ্গারা

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব অনুযায়ী, কক্সবাজারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ৮০ শতাংশ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকেছে।

মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে আসার আগে থেকেই তাদের একটি বড় অংশের জীবিকার একমাত্র উপায় ছিল মাদক পাচার।”

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক বলেন, “এখনও কোন সময়ে, কোন পথ দিয়ে, কীভাবে ‘ইয়াবা’ আনতে সুবিধা হবে, তা রোহিঙ্গারাই সবচেয়ে ভালো জানে।”

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সৌমেন মণ্ডল বেনারকে বলেন, “স্থানীয় মাদক-সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের শুধু পাচারের কাজেই ব্যবহার করছে না, তাদের ক্যাম্পগুলোকে ইয়াবা মজুদ ও লেনদেনের ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছে।”

“কারণ তারা জানে, ক্যাম্পগুলো ‘স্পর্শকাতর’ এলাকা হওয়ায় সেখানে যখন তখন অভিযান চালানো অসম্ভব,” যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি এখন প্রতি রাতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের যৌথ টহল চালু করা হয়েছে।”

ইয়াবারপ্রবেশদ্বার’ টেকনাফ

গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় কক্সবাজারের যে এক হাজার ১৫২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, তাদের ৯১২ জনই টেকনাফের। ইয়াবার ‘প্রবেশদ্বার’ খ্যাত সীমান্তবর্তী এই উপজেলায়ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির পর ইয়াবা আটকের পরিমাণ বেড়েছে।

টেকনাফের বিজিবি, কোস্ট গার্ড, র‍্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৬ সালে সালে টেকনাফ উপজেলা থেকে উদ্ধার করা ইয়াবার মোট পরিমাণ দেড় কোটি পিসের কম হলেও ২০১৭ সালে উদ্ধার করা ইয়াবার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি, আর ২০১৮ সালে এই পরিমাণ আড়াই কোটি ছাড়িয়ে যায়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) টেকনাফ শাখার সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী বেনারকে বলেন, “গত বছর থেকে সরকার ইয়াবার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার পর এখান ইয়াবা ব্যবসা কিছুটা কমেছে।”

স্থানীয় লেদা ক্যাম্পের ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ইয়াবা সংশ্লিষ্টতা অনেকটাই কমেছে। তবে তাদের দিয়ে এই ব্যবসা করাতে একটি প্রভাবশালী মহল এখনও বেশ তৎ​পর।”

আরও খবর