সুদিনের পথে অনলাইন মিডিয়া…

অনেকটা নীরবেই এগোচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অনলাইন ঘরানার বিপ্লব। এখন দেশের সব ঘরানার সংবাদমাধ্যমেই এ ডিজিটাল গণমাধ্যমের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছে। গুছিয়ে অনলাইনে সংবাদ পরিবেশন করছে এমন অনলাইনের সংখ্যা ২০টিরও বেশি।

দেশের অনলাইন বিজ্ঞাপনের বাজার ১০ কোটি টাকার অঙ্ক ছাড়িয়েছে বহু আগেই। সংযুক্ত সেবা (বাই প্রডাক্ট) হিসেবে দেশের ১৫টি শীর্ষ কাগুজে পত্রিকা এখন অনলাইনে বাড়তি বিনোয়োগ এবং আগ্রহ প্রকাশ করছে। এতে কাজের দক্ষতা প্রমাণ করছে তরুণেরাই বেশি। কাজেই বৈশ্বিক সমীকরণে নব্য ঘরানার একটি কাজের আবহ তৈরি হচ্ছে।

বর্তমানে দেশের শীর্ষ ব্যবসা গ্রুপগুলো অনলাইন মিডিয়ায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। আসছে ২০২০ সালের দেশের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার ধরতেই এমন আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে এগিয়ে থাকা দূরদর্শী বিনিয়োগকারীরা।

সামাজিক জনমাধ্যম ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার আর গুগল ইউনিকোড সার্চ ইঞ্জিনের কারণে ইন্টারনেট দুনিয়ায় বাঙলা ভাষার প্রসার ও জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। বর্হিবিশ্বের হাওয়া বদলের চেহারা দেশের উন্নয়নশীল মিডিয়া অঙ্গনেও প্রভাব ছড়াচ্ছে। নতুন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘এখন দেশে প্রায় ৯ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে ৮ কোটি (প্রায়) মানুষ।’

এ ছাড়া বাংলাদেশে ১০ কোটিরও বেশি মোবাইল গ্রাহকের সরব উপস্থিতি অনলাইন মিডিয়া জোয়ারের কথাই বলছে। গবেষণা সূত্রেও এমন ভাবনার সত্যতা স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিদিনই।

অবস্থা যখন এমন তখন একে একে বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো অনলাইনে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরিতে মনযোগী। এ তালিকায় বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, ওমাহা ওয়ার্ল্ড-হেরার্ল্ড, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মতো পত্রিকাও আছে।

শুধু স্থবির কম্পিউটার নয়, তারহীন ইন্টারনেট এবং স্মার্ট পণ্যের কল্যাণে বিশ্ব এখন তথ্য ও যোগাযোগের অপ্রতিরোধ্য কর্মক্ষেত্র। ইন্টারনেট সংযুক্ত আছে এমন কম্পিউটারের সংখ্যা এখন ৫৭ কোটি ৫০ লাখ। সিআইএ ফ্যাটবুক সূত্র এ তথ্য দিয়েছে।

বিশ্বের ইন্টারনেটের গতিপ্রকৃতি চৌম্বক আবহের নেটওয়ার্কের পেছনে ছুটবে । এ নেটওয়ার্কে সংশ্লিষ্ট কারো দূরে সরে থাকা সত্যিই কঠিন হবে।

এদিকে ১৭ (প্রায়) কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে এখন ফেসবুকের সক্রিয় ভোক্তা ৩৩ লাখ ছাড়িয়েছে। তুলনাচিত্রে ২০০০ সালে বাংলাদেশের সক্রিয় ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল মাত্র ১ লাখ। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে তা ১ কোটি ২০ লাখে পৌঁছেছে। সমীকরণের প্রবৃদ্ধি সূত্রে এটি শতকরা ৫৫ ভাগ।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা আর প্রকাশনা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় হোঁচট খেয়ে বৈরী বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় ছাপানো সংবাদমাধ্যমকে। একে সংবাদপত্রের ইতিহাসে ধসের বছর বলেও অভিহিত করেছেন অর্থনীতি গবেষক এবং বিশ্লেষকেরা।

অনলাইন সংবাদমাধ্যম আর ডিজিটাল সিস্টেমের নানামুখী অভূতপূর্ব কৌশলের কারণে ক্রমেই এ সংস্কৃতির সফল বির্বতন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার এমন তথ্য দিয়েছে।

শুধু গণমাধ্যম নয়, পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক চর্চা আর প্রয়োগিক পদ্ধতিও রাতারাতি বদলে যায়। শুরু হয় অনলাইন বিশ্বের দিবারাত্রীর অগ্রযাত্রা। ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয় এ মাধ্যম। বিপরীতে কোণঠাসা হয়ে ব্যবসা হারাতে থাকে কাগুজে সংবাদপত্র।

বিশ্বব্যাপী সার্কুলেশন আর ছাপানো পণ্যের দাম অপ্রত্যাশিত হারে বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ের তাল সামলে টিকে থাকাই কঠিন হয় ছাপানো সংবাদমাধ্যমের। একে একে এ কাতারে এসে দাঁড়াতে থাকে বিশ্বের শীর্ষ আর ঐতিহ্যবাহী সংবাদমাধ্যমগুলো।

ইন্টারনেট বাক্সবন্দি চারকোণা ডেস্কটপ পিসির আঙ্গিনা ছেড়ে পাড়ি জমায় মোবাইল, স্মার্টফোন আর ট্যাবের খুদে আঙ্গিনায়। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আর জনপ্রিয়তার আভাস দিতে থাকে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো। পিউ প্রকল্পের অধীনে ‘এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজম’ গবেষণাপত্রে এসব তথ্যের খোঁজ মিলল।

যুক্তরাষ্ট্রের ১,৩৮০টি ছাপানো সংবাদমাধ্যম থেকে ৪৫০টি এখন পুরোপুরি অনলাইন গণমাধ্যমের কাতারে এসেছে। এ তালিকায় শুধু নিউ ইয়ক টাইমস নয়, বরং ছোট ও মাঝারি ঘরানার সংবাদমাধ্যমও আছে।

এসবের মধ্যে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম ছাপানো সংস্করণ অব্যাহত রাখলেও এদের সার্কুলেশন দারুণভাবে কমানো হয়েছে। এ চিত্রের বিপরীতে ‘পেওয়্যাল’ পেমেন্ট অর্থাৎ সামান্য বিনিময় অর্থে পূর্ণ অনলাইন সংবাদ পাঠকের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে।

সুতরাং একদিকে বিশ্বব্যাপী ছাপানো সংবাদমাধ্যমের কাটতি কমতে থাকে। অন্যদিকে দেরিতে সংবাদ প্রকাশের কারণে পাঠত প্রিয়তাও ক্রমেই কমে যায়। বিশ্বের মিডিয়া বিনিয়োগ মুঘল খ্যাত ওয়ারেন্ট বাফেটও এ সত্য সহজেই অনুধাবন করে ধীরে ধীরে তার মালিকানাধীন প্রকাশনা মাধ্যমগুলোকে গুটিয়ে অনলাইনমুখী করার উদ্যোগ নেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৩ সালে ৬৩টি দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকা অনলাইনে চলে যায়। এমন সিদ্ধান্ত টিকে থাকার স্বার্থেই বলে মিডিয়া বিশ্লেষকেরা অভিমত দিয়েছেন।

নিউজউইক। ভুবনখ্যাত এ প্রকাশনার নাম খুব কম সচেতন পাঠকেরই অজানা। সুদীর্ঘ ৮০ বছরের ছাপানো ইতিহাসের ইতি টেনেছে নিউজউইক প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ। ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ সালেই নিউজউইক প্রকাশনার ইতি হয়।

ইন্টারঅ্যাকটিভ করপোরেশনের (আইএসিআই) মালিকানাধীন এ প্রকাশনা মাধ্যমটি নিয়ে কর্তৃপক্ষ আরও সফল ব্যবসা করতেই ছাপানো থেকে অনলাইন সংস্করণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এ প্রসঙ্গে নিউজউইকের এডিটর-ইন-চিফ টিনা ব্রাউন বলেন, সময় এখন ডিজিটাল প্রকাশনার। একে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। প্রকাশনা শিল্পে ব্যয়ভার আর সার্কুলেশন ব্যবস্থাপনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় খরচের সঙ্গে তাল মেলানো এখন কঠিন কাজ।

বিশ্বের সব দেশের পাঠক এবং বিজ্ঞাপন দাতাদের কাছ থেকে নিউজউইকের অনলাইন সংস্করণের জন্য ব্যাপক চাপ আসতে থাকে। ফলে সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রকাশনা আর অনলাইন এ দু’সংস্করণকে একসঙ্গে না টেনে অনলাইনেই প্রধান করে নিউজউইক।

পুরোনো সংস্কৃতির এ আমূল পরিবর্তন এনেছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের বয়স ৪ দশকের অঙ্ক পেরিয়েছে। স্যোশাল মিডিয়া, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট এবং নতুন মোবাইল অ্যাপলিকেশনের হাত ধরে বিশ্বের অবিচ্ছেদ্য একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম এখন অনলাইন মিডিয়ার দখলে।

আসছে ২০২০ সালে এটি হবে অনিবার্য সত্য। অর্থাৎ বিশ্বের অধিকাংশ নাগরিকের কাছেই পৌঁছে যাবে ইন্টারনেটের সুফল। গুগল চেয়ারম্যান এরিক স্মিডও এমন ইঙ্গিত করেছেন।

ব্যবসা, বিপণন আর স্যোশাল মিডিয়া এ ত্রিমুখী পথই দখলে নিয়েছে ইন্টারনেট। অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের পুরো কার্যক্রমের শাসন ও নিয়ন্ত্রক হবে ইন্টারনেট।

এ মুহূর্তে বিশ্বের ২৪৬ কোটি মানুষ স্মার্টফোন আর ৪৯২ কোটি মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করছে। বিপরীতে বিশ্বের জনসংখ্যা এখন ৭০০ কোটি পেরিয়েছে। ক্রমবর্ধমান ইন্টারনেট জনসংখ্যা নিশ্চিতভাবেই ২০২০ সালের বিশ্বের মূল জনসংখ্যার কাছাকাছি অঙ্কে পৌঁছবে। তখন মিডিয়াসহ সবকিছুই সম্পাদন হবে অনলাইনে।

এহেন ভবিষ্যৎ ভাবনায় ২০২০ সালে ইন্টারনেট জনসংখ্যা ৫০০ কোটির অঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং অনলাইন কারিগরি শৈলীতে এটি বিশ্বের সামনে নব যুগের সূচনা করবে। দ্য ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এ কথা বলেছে।

অনলাইনে গবেষকেরা বলছেন, ২০১০ সালের পরের ১০ বছরে ইন্টারনেট বিশ্বে বিপ্লব সূচিত হবে। বিশ্বের উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ক্রমেই ডিজিটাল বৈষম্য দূর হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের গাণিতিক প্রবৃদ্ধিতে মধ্যপ্রাচ্যে ২৮.৩, এশিয়া ১৯.৪ এবং আফ্রিকা ৬.৮ ভাগ এগিয়েছে।

২০২০ সালে বিশ্বের বহু দেশের দুর্গম অঞ্চলেও ইন্টারনেট সেবা সুনিশ্চিত হবে। এ জন্য স্মার্টফোন হবে সবচেয়ে সক্রিয় মাধ্যম। আর ইন্টারনেট সংস্কৃতিতে বহু ভাষার অবাধ চর্চা হওয়ায় গ্রাহক সংখ্যাও বাড়বে হু হু করে।

এ ইন্টারনেট প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও ২০২১ সালে সফলভাবেই এগোবে। এ লক্ষ্যের পথ ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্নও সুগম হবে। নিশ্চিতভাবেই এ অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যম আয়ের দেশে জায়গা করে নেবে।

আরেকটি উদাহরণে গল্পে বলা যায়, ২০০৫ সালে সাধারণ লেখকদের প্লাটফর্ম তৈরিতে আত্মপ্রকাশ করে হাফিংটন পোস্ট। মাত্র এক বছরের মধ্যে এটি সাধারণ পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। এরপর নিত্যনতুন ভাবনার সংযোজন করেন হাফিংটন পোস্টের এডিটর ইন চিফ আরিয়ানা। জনসাধারণের কাছে আরও জনপ্রিয় হতে বিশ্বব্যাপী প্রদায়ক নিয়োগ করতে থাকেন আরিয়ানা।

এর ঠিক পরেই ২৪ ঘণ্টার অনলাইন পোর্টাল করার কথাও ভাবেন আরিয়ানা। কাছের বন্ধুদের আর্থিক সহায়তায় হাফিংটন পোস্টে যুক্ত হয় ২৪ ঘণ্টার সংবাদ, ভিডিও রিপোর্টিং আর ভিডিও ব্লগিং। ক্রমশ বাড়তে থাকে পাঠক, লেখক আর বিজ্ঞাপন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে আরিয়ানার ‘হাফিংটন পোস্ট’ পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হয়।

হাফিংটন পোস্টকে কেন্দ্র করে আরিয়ানার জনপ্রিয়তা আজ বিশ্বব্যাপী। আরিয়ানা হাফিংটন নিজের লেখনি শক্তিতে তৈরি করেছেন হাজারো লেখক। এ কাজে আরিয়ানাকে উৎসাহ দিচ্ছেন অসংখ্য পাঠক।

আরিয়ানা বিশ্বাস করেন, অনলাইন কনটেন্ট দিয়ে বিশ্বের কাছে নিজের যৌক্তিক আর শক্তিশালী কথা উপস্থাপনযোগ্য। আর এ বিশ্বাসকেই বাস্তব করে তুলেছে হাফিংটন পোস্ট। যাকে ঘুরিয়ে বললে এভাবে বলা যায়, আগামীর সব কিছুরই নিয়ন্ত্রক হবে অনলাইন মিডিয়া। আর সব ধরনের আর্থিক লেনেদেনই হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। গণমাধ্যমেও আধিপত্য আর একচ্ছত্র প্রকাশ করবে অনলাইন মিডিয়া।

লেখক: সাব্বিন হাসান

sabbin@gmail.com

আরও খবর