মৌলভি মুজিবুর রহমান, আজিজ, রফিকসহ কয়েকজনের ব্যাপারে ফের তদন্তের নির্দেশ

নাম কাটানোর তদবিরেও ব্যস্ত ইয়াবা ডনরা

কালেরকন্ঠ :

কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই মৌলভি মুজিবুর রহমান, বদির ছায়াসঙ্গী মৌলভি আজিজ, মৌলভি রফিকসহ কয়েকজন ‘ইয়াবা গডফাদারের’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য জোর তদবির শুরু করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে এই তদবিরের কারণে মন্ত্রণালয় থেকে তাঁদের বিষয়ে আবারও যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের টেকনাফ উপজেলা পর্যায়ের নেতা মৌলভি মুজিবুর রহমান ইয়াবা গডফাদারের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করতে প্রভাবশালীদের কাছেও ধরনা দিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই প্রভাবশালীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর বিষয়ে কথা বলেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তাও মৌলভি মুজিবুরের বিষয়ে আরো ভালোভাবে খোঁজ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনা পাওয়ার পর কক্সবাজার জেলা পুলিশ গডফাদারদের বিষয়ে পৃথক অনুসন্ধান শুরু করেছে।

কক্সবাজারে ইয়াবা পাচারকারী ও গডফাদারদের আত্মসমর্পণের তোড়জোড় চলার মধ্যে চলছে এই তদবির। অথচ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচারে যাঁর বিরুদ্ধে সর্বাধিক অভিযোগ উঠেছে তিনি হলেন মৌলভি মুজিবুর রহমান। সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই এবং টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর হওয়ার সুবাদে তিনি সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেন বলে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে আসে।

তদবিরকারী তিনজনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৭৩ জন ইয়াবা পাচারকারী ও গডফাদারের একটি তালিকা করে। এই তালিকার ১ নম্বরে রয়েছেন সে সময়ের সংসদ সদস্য (এমপি) আবদুর রহমান বদি। আর বদির ভাই মৌলভি মুজিবুর রহমান রয়েছেন তালিকার ১৫ নম্বর ক্রমিকে।

প্রায় ৫২ বছর বয়সী মুজিবুর টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর। তাঁকে ইয়াবা পাচারকারীদের আত্মসমর্পণপ্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে সুপারিশও করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তদবির করেছেন তালিকার ২৫ নম্বর ক্রমিকে থাকা টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মৌলভি আজিজ (৪০) ও ২৬ নম্বর ক্রমিকের টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভি রফিক উদ্দিন (৪০)। তাঁরা দুজনই যমজ ভাই। দুজনই সাবেক এমপি ও তালিকার ১ নম্বর ক্রমিকে থাকা আবদুর রহমান বদির খুবই ঘনিষ্ঠজন। এই দুই ব্যক্তি বদির ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকেন বলে এলাকায় প্রচার আছে।

তালিকাভুক্ত তিন গডফাদারের বিষয়ে পুনরায় অনুসন্ধান শুরুর বিষয়টি কক্সবাজারের একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা তালিকায় থাকা তিনজনের বিষয়ে পুনরায় অনুসন্ধান চালাচ্ছি।’ তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া বা তাঁরা ভালো লোক—এমন প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা আছে কি না জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায়ে যে তথ্য পাব, সেই বিষয়ে সঠিক প্রতিবেদন দেব।’

ইয়াবা গডফাদারদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তদবির এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনের বিষয়ে পুনরায় অনুসন্ধানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’ তিনি এ প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘এসব বিষয়ে আপনাকে কে বলেছে?’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তদবির করার বিষয়ে জানতে চাইলে বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভি আজিজ উদ্দিন গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবদুর রহমান বদি ভাইয়ের সঙ্গে আমি ও আমার ভাই মৌলভি রফিক উদ্দিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের শোকরানা সভায় এসেছি। এর আগেই আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। কারণ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা তালিকায় আমরা দুই ভাইয়ের নাম থাকলেও প্রকৃতপক্ষে আমরা ইয়াবা পাচারকারী নই।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মৌলভি মুজিবুর রহমানও ঢাকায় এসে অনুরূপ আবেদন করেছেন।

ইয়াবা তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য হেফাজতে ইসলামীর আমিরের সহযোগিতা চাওয়া এবং তাঁর মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদবির করার বিষয়ে জানতে চেয়ে মৌলভী মুজিবুর রহমানকে মোবাইল ফোন কল করে এবং মেসেজ পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

চলমান রয়েছে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারীরা আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টার অংশ হিসেবে গতকাল শনিবারও কয়েকজন পাচারকারী পুলিশ লাইনে জড়ো হয়। জেলা পুলিশ লাইনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে এ রকম অন্তত ৭০ জন জড়ো হয়েছে। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ইয়াবাসহ আত্মসমর্পণ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।

আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া কেমন হবে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছু ইয়াবা পাচারকারী ভালো হয়ে যাওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। তারা কোন প্রক্রিয়ায় আত্মসমর্পণ করবে, তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে সেই বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত আসেনি।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চপর্যায় থেকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার পরই বলা যাবে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া কীভাবে হবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি মাসের শেষভাগ বা ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে।’

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় থাকা ৭৩ জন এবং ওই তালিকার বাইরে জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত অন্তত ৭০ পাচারকারী এরই মধ্যে পুলিশ হেফাজতে চলে গিয়েছে। তাদের এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। কোন প্রক্রিয়ায়, কিভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হবে বা কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে তা এখনো ঠিক করেনি পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কক্সবাজার আসবেন। সেই পর্যন্ত আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা কক্সবাজার পুলিশ লাইনে হেফাজতে থাকতে পারে।

জানা গেছে, পুলিশ হেফাজতে যাওয়া পাচারকারী বা ইয়াবা মামলার আসামিরা ভালো আছে। নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করছে। লুডু খেলে সময় পার করছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭৩ জনের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ২৩ জন আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ হেফাজতে গেছে। বাকি যারা গেছে তারা পুলিশের তালিকাভুক্ত। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তালিকায় ইয়াবা পাচার মামলার আসামি ও পাচারকারীর সংখ্যা এক হাজার ১৫১ জন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭৩ জনের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা পুলিশ হেফাজতে গেছেন তাঁরা হলেন আব্দুল আমিন, মো. নুরুল হুদা, দিদার মিয়া, সাহেদুর রহমান নিপু, মো. সফিক, মো. ফয়সাল, এনামুল হক, ছৈয়দ হোসেন মেম্বার, শাহেদ কামাল, শাহ আলম, আবদুর রহমান, মোজাম্মেল হক, জোবাইয়ের হোসেন, নুরুল বশর ওরফে নুশসাদ, কামরুল হাসান রাসেল, আবদুর রহমান, জিয়াউল রহমান, মো. নুরুল কবির, মারুফ বিন খলিল প্রকাশ বাবু, মো. ইউনুছ, ছৈয়দ আহমদ ছৈয়তু, জামাল হোসেন ও রেজাউল করিম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকজন এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে।

আরও খবর