শাহীন মাহমুদ রাসেল:
শ্রমিকের শ্রমের ওপর নির্ভর করেই ইটভাটার মালিকরা কোটি কোটি টাকা আয় করলেও শ্রমিকদের ভাগ্যে জোটে শারীরিক নির্যাতন আর বঞ্চনা। প্রতি বছর ইটের মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও বাড়ে না শ্রমিকের মজুরি। প্রতিদিন ৪০০ টাকায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা শ্রম দেয় শ্রমিকরা। আর তাদের মাথাপিছু ৪০০ টাকা করে নিয়ে যায় দালালরা।
দালালরা শ্রমিকদের টাকা আগেভাগে বুঝে নেয়ার কারণে ওই টাকা সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে অথবা শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে কাজ আদায় করে নেয়া হয়। অনেক সময় দালালদের দাদন পর্যন্ত দেয়া হয়। তবে এ জন্য কোনো নীতিমালা না থাকায় বছরের পর বছর ইটভাটায় চলছে শ্রমিক নির্যাতন। এমনকি শ্রমিকদের মজুরি ইটভাটা ব্যবসার প্রধান খরচ হওয়ায় অসাধু ভাটা মালিকরা দালালদের দাদন দেয়ার মারপ্যাঁচে পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের মজুরি আত্মসাতের মাধ্যমে বাড়তি লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে। ইটভাটা শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা ও প্রাপ্য মজুরি নির্ধারণের দাবি উঠেছে।
সম্প্রতি কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলার পিএমখালীতে এম.আর.সি ইটভাটায় শ্রমিক আটকে রেখে জোরপূর্বক কাজ করানো এবং নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া যায়। পরে ভুক্তভোগীদের স্বজনরা তাৎক্ষণিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে বিষয়টি অবহিত করলে তারা বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করার পরামর্শ দেন। এরপর ৩ দিন শ্রমিকদের আটকে রেখে কাজ করানো হলেও তাদের কেউ উদ্ধার করতে যায়নি। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও কুমারখালী উপজেলা থেকে ওই ভাটায় কাজ করতে আসা ৫ শ্রমিককে একটি ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে। দিনে তাদের পাহারা দিয়ে কাজ করানো হয়। ১৫ দিন এভাবে কাজ করানো হলেও তাদের কোনো মজুরি দেয়া হয় না।
ভাটার মালিক মোবারক হোসেনের অভিযোগ, শ্রমিক সরবরাহকারী দালাল সহিদ অগ্রিম ৪ লাখ টাকা নিয়েছে। তাই শ্রমিকদের আর টাকা দেয়া হবে না। ৪ লাখ টাকার শ্রম না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের কাজ করে যেতে হবে। দালাল সহিদ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে তার দায় কেন শ্রমিকদের? এমন প্রশ্নের উত্তরে মোবারকসহ স্থানীয়রা জানান, ইটভাটার নিয়ম এটাই, শ্রমিক সর্দার বা দালাল টাকা নিলেও শ্রমিকদেরই কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে।
আটক থাকা শ্রমিক জামিল জানান, ‘দালাল সহিদ কত টাকা নিয়েছে তা আমরা জানি না। আমাদের সামনে কোনো লেনদেন হয়নি, এমনকি আমরা কেউ টাকার জিম্মাও হইনি। আমাদের কোনো টাকা না দিয়ে জোর করে কাজ করানো হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান ও পুলিশের উপস্থিতিতে শ্রমিকদের মুক্তি দেয়া হয়।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরের পর বছর বিভিন্ন ইটভাটায় নীরবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে। প্রথম দিকে র্যাব-পুলিশ এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করলেও এখন বিষয়টি তাদের কাছে সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে এখন শ্রমিক নির্যাতনের চেয়ে ভাটার মালিকের লাভ-ক্ষতির দিকটি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজার জেলায় বৈধ ও অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৫০টি। এসব ইটভাটায় ইট তৈরি, পরিবহন, জ্বালানি, মাটি কাটাসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে কাঁচা ইট তৈরির মৌসুমী শ্রমিকই বেশি। পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাফ ইটভাটায় শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, ইটভাটার অনুমোদন পরিবেশ অধিদফতর প্রদান করলেও শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি আমরা করি না। এ বিষয়ে আমাদের কিছু করণীয় নেই।
শ্রম অধিদফতরের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানালেন, উদ্বেগের বিষয় হলো ইটভাটায় শ্রমিক আটকে মজুরি না দেয়ার ঘটনা বেড়ে চললেও অধিকাংশ ইটভাটা গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এসব ঘটনা প্রকাশ পায় না।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-