কারবারিদের আত্মসমর্পণ করানোর উদ্যোগ

কী হবে মাদকের গডফাদারদের

সমকাল :

মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ করানোর একটি প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সে লক্ষ্যে একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তালিকা সম্পন্ন হলেই তার ভিত্তিতে নেওয়া হবে মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণ করানোর উদ্যোগ। পুলিশ এরই মধ্যে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে পুলিশের এমন উদ্যোগ ও প্রস্তুতির মধ্যেই গত শুক্রবার কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি তালিকাভুক্ত এবং তালিকার বাইরে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের প্রতি আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, সতর্কতার সঙ্গে না এগোলে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে মাদকের বড় কারবারি ও গডফাদাররা ‘ক্লিন চিট’ বা একপ্রকার নিস্তার পেয়ে যেতে পারেন। এতে মাদকবিরোধী অভিযানের দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক সফলতা ব্যাহত হতে পারে। তবে পুলিশের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করেই আত্মসমর্পণকারীদের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। মাদকের গডফাদাররা ছাড় পাবে না। তাদের ব্যাপারে ‘কঠোর নীতি’ বহাল থাকবে। তবে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় মাদকসেবী, মাদকের বাহক ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে ছোটখাটো কারবারে জড়িতরা থাকবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে অনেকে মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। তবে হঠাৎ করে সাবেক এমপি বদির দেওয়া  বক্তব্য সর্বসাধারণের  মধ্যে এ বিষয়ে ভুল বার্তা যেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। কারণ তিনি সবাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন। যেটা এ বিষয়ে সরকারের নেওয়া নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, মাদকসেবী, ব্যবহারকারী ও বহনকারীদের অবশ্যই স্বাভাবিক জীবনে আসার সুযোগ দিতে হবে। তবে সবার আগে গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা দরকার। সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনোভাবে মাদকের বড় কারবারিরা শাস্তি থেকে অব্যাহতি না পায়। যে কোনো মূল্যে তাদের নির্মূল করতে হবে।

মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে আত্মসমর্পণকারীদের তালিকা তৈরি করতে হবে। রাঘববোয়ালরা যাতে ক্লিন চিট পেয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। বিচারবহির্ভূত হত্যার পরিবর্তে যে কোনো ধরনের অপরাধীকে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তির আওতায় আনার ব্যাপারে মত দেন তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, তারাই কেবল আত্মসমর্পণ কার্যক্রমের আওতায় আসবে যারা মাদকের ক্ষেত্রে ‘ভিকটিম অব সারকামস্ট্যান্স’। এটা হতে পারে জীবনযাপনের তাড়নায় বা বিকল্প কর্মংসংস্থান না পাওয়ায় যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক বহন করছে অথবা খুচরাভাবে মাদক বিক্রি করছে তারা। কোনো গডফাদার যাতে এ প্রক্রিয়ায় মধ্যে ঢুকে যেতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে পুলিশ।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন সমকালকে বলেন, এর আগে জলদস্যু-বনদস্যুরা আত্মসমর্পণ করেছে। বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে ইয়াবা কারবারিরাও আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এরপর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু পুলিশি অভিযানের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য সামাজিক উদ্যোগও জরুরি। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি সেই উদ্যোগের অংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথমেই মাদকের ‘রাজধানী’খ্যাত টেকনাফের ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হতে পারে। যারা আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

সংশ্নিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে মাদক-সংক্রান্ত ঘটনার মামলা রয়েছে, আত্মসমর্পণের পর তারা সেই মামলা থেকে অব্যাহতি পাবে না। তবে আত্মসমর্পণকারীদের বিরুদ্ধে নতুনভাবে কোনো মামলা দায়ের করা হবে না। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় আসার পরও তাদের ওপর নজরদারি অব্যাহত থাকবে। আত্মসমর্পণকারীদের সম্পত্তির হিসাব খতিয়ে দেখা হবে।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এমন অনেকে রয়েছে জীবিকার তাগিদে বছরের পর বছর ধরে মাদক বহন করে আসছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে বহু মামলাও রয়েছে। এ ধরনের কেউ আত্মসমর্পণ করলে তার পুরনো মামলার ব্যাপারে আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে। অন্য একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, মাদকের সঙ্গে জড়িতদের একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, এ পথে কেউ একবার এলে সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। এটা এক ধরনের ‘ওয়ান-ওয়ে’ রুট। এ ধারণা ভেঙে দিতে চায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষ করে যারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আত্মসমর্পণ করলে তাদের অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ভিন্নমতও রয়েছে। তাদের যুক্তি, যারা মাদক ব্যবসা করে এরই মধ্যে ‘রুই-কাতলা’ হয়েছে। এ ব্যবসা কোনো আদর্শিক বিষয় নয়। তারা মূলত ব্যক্তিগত লাভের জন্যই এ কারবারে জড়িয়েছে। তাই জঙ্গি, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জলদস্যু-বনদস্যুদের সঙ্গে মাদকের রাঘববোয়ালদের এক কাতারে ফেললে চলবে না। আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে পলাতক অনেক বড় মাদক ব্যবসায়ী সাময়িকভাবে রেহাই পেয়ে যেতে পারে। পরে পরিস্থিতি বুঝে বা প্রভাব খাটিয়ে তাদের আবারও মাদকে অথবা অন্য কোনো অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেউ কেউ তার সম্পদ রক্ষা করতেও আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে।

গত বছরের ৪ মে থেকে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে র‌্যাব। ১৮ মে থেকে অভিযানে নামে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত মাদক-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫৫২টি। গ্রেফতার হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮০৩ জন। ২০১৮ সালে সব সংস্থার হাতে জব্দ হয় ৩ কোটি ৪৯ লাখ ইয়াবা বড়ি। অভিযানে নিহত হয়েছে চার শতাধিক। চলতি বছর এরই মধ্যে একাধিক মাদক ব্যবসায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও বলছেন, নতুন বছরে মাদক নির্মূল করাই হবে তাদের প্রধান অগ্রাধিকার। মাদকবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হবে। তবে এসব অভিযানের তারা ‘হার্ড ও সফট’ অ্যাপ্রোচ নিয়ে এগোবে। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি সফট অ্যাপ্রোচের অংশ।

কক্সবাজার ও টেকনাফে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এমন প্রক্রিয়ার কথা জানার পর অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছে। অনেকে ব্যাপারটা আরও বোঝার চেষ্টা করছে।

জলদস্যু ও বনদস্যুরা আত্মসমর্পণের সময় তাদের হেফাজতে থাকা অস্ত্র জমা দিয়েছে। ইয়াবা কারবারিরা কী জমা দেবে? সংশ্নিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলছেন, যদি কারও হেফাজতে ইয়াবা থাকে তা নিয়ে আত্মসমর্পণ করবে সে। ২০১৬ সাল থেকে এ যাবত ২৬টি জলদস্যু বাহিনীর ২৭৪ জন র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এ সময়ে ৪০৪টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ১৯ হাজার ১৫৩ রাউন্ড গুলিও পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে।

বদির বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া : শুক্রবার টেকনাফ চৌধুরীপাড়ায় নিজ বাসভবনে কক্সবাজার-৪ আসনে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য শাহীন আক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন এলাকাবাসী ও দলীয় নেতাকর্মীরা। ওই সময় তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন এই আসনের সাবেক এমপি বদি। নবনির্বাচিত এমপি শাহীন আক্তার তার স্ত্রী। বক্তৃতার সময় বদি মাদক ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ছেলেহারা মা-বাবা, স্বামীহারা স্ত্রী ও বাবাহারা সন্তানদের কথা চিন্তা করে আপনারা আত্মসমর্পণ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তালিকাভুক্ত এবং তালিকার বাইরে যেসব ইয়াবা কারবারি রয়েছেন, তারা সবাই আত্মসমর্পণ করুন। ইয়াবা টেকনাফবাসীর জন্য অভিশাপ।’ পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ ২৩ জনপ্রতিনিধির নাম রয়েছে। তবে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলে দাবি করে আসছেন বদি। শুক্রবার তার আত্মসমর্পণের আহ্বানের ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধি তার জনপ্রিয়তাকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক- দু’ভাবে কাজে লাগাতে পারেন। আবদুর রহমান বদির আহ্বানকে স্বাগত জানাতে চাই। এতে কক্সবাজার ও টেকনাফকেন্দ্রিক ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ওপর এক ধরনের সামাজিক চাপ তৈরি হতে বাধ্য।’

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এমপি বদি ওই কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, ‘তিনি এমপি হতে পারলে ইয়াবা নিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ার বদনাম ঘোচাবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত দলের মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে এমপি হয়েছেন তার স্ত্রী। টেকনাফের মতো এলাকায় বদি সত্যিকার অর্থে চাইলে অনেক কিছু পরিবর্তন সম্ভব বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করেও বদির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলা যায়নি। 

আরও খবর