শহিদুল করিম শহিদ:
স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিশু কিশোর ও তরুণরা দিন দিন ঝুঁকছে ইয়াবার নেশায়। যারা আগামী দিনের বাংলাদেশ বিনির্মানে নেতৃত্ব ও কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করবে-তাদের হাতেই এখন সর্বনাশা ইয়াবা। কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টানের চিত্র এটি। শহরের কয়েকটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। যা ভয়াবহ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।ইয়াবা এখন সবার কাছে পরিচিত একটি মাদকের নাম। যার গ্রাসে ধ্বংস হচ্ছে চীর সবুজ তারুণ্য। বর্তমানে এ পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।
বিশেষ করে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারাও জড়িয়ে পড়ছে এই সর্বনাশা নেশায়। মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা ‘বাবা’ নামেও পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনেই এর লেনদেন হয়। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে উঠে আসে, বর্তমানে মাদকসেবীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ হলো ইয়াবা সেবনকারী। আর এদের মধ্যে ২০ শতাংশই নারী। আসক্তদের অধিকাংসই তরুণ-তরুণী। ইয়াবা সেবন করলে দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে স্নায়ুতে উত্তেজক ক্রিয়া শুরু হয়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এ সময়ের মধ্যে ব্যবহারকারী অতিপুলক অনুভব করে। অন্যরকম এক জগতে বাস করে। কিন্তু এর প্রভাব কেটে যাওয়ার পর মাদকটি গ্রহণ না করলে সোজা আকাশ থেকে পাতালে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়।
কক্সবাজার শহরের আলীর জাঁহাল ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্র নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছে। এরা শহরের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্টানে অধ্যয়ণরত। অনেকেই এসএসসি পরীক্ষার্থী। এই কেন্দ্রের পরিচালক জসিম উদ্দিন কাজল জানান, “এক সময় শুধু একটা শ্রেণির মানুষেরা মাদক গ্রহণ করতো। আর এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবীসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষই এতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো স্কুল পড়োয়া অষ্টম-নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র এই নেশায় ডুবে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমাজের সচেতন মহল, অভিভাবকগনের সচেতনতা খুবই জরুরী।বাইপাস সড়কের নোঙ্গর নামের নিরাময় কেন্দ্রেও রয়েছে শিশু কিশোর ও তরুণ। তাদের কয়েকজন চিকিৎসা শেষে বাড়ী ফিরেছে। নুনিয়ারছড়ার ইরফান (ছদ্মনাম) শহরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্টানের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সে গত ১বছর ধরে ইয়াবায় আসক্ত। তাকেও এই নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ঝিলংজা হাজীপাড়ার কায়েস (ছদ্মনাম) এবারের এসসসি পরীক্ষার্থী। পার্শ্ববর্তী স্কুলের ছাত্র। সেও ইয়াবা সেবনের কারনে একই নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। এই নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক রাশেদও স্বীকার করেন ইয়াবা আসক্ত স্কুল পড়–য়া কয়েকজন ছাত্র তার প্রতিষ্টানে চিকিৎসাধীন। আবার চিকিৎসা শেষে বাড়ী ফিরেছে আরো কয়েকজন।
তার মধ্যে কক্সবাজার শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানের কিশোর ও তরুণরা রয়েছে। তিনি বলেন, মরণ নেশা ইয়াবা গ্রামে-গঞ্জে শহরে সব জায়গায় এখন ছড়িয়ে আছে।এদিকে প্রতিবছর মিয়ানমারসহ পাশের দেশগুলো থেকে হাজার কোটি টাকার ইয়াবা বাংলাদেশে আসে। এই ইয়াবার একটি বড় অংশই গ্রহণ করছে স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা-স্বীকার করেন তিনি। অপরদিকে ইয়াবা সেবনের মধ্য দিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। ইয়াবা সেবনে সাময়িক আনন্দ পাওয়া গেলেও পরে আসক্ত ব্যক্তি নানা ধরণের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মূলত ইয়াবার মাধ্যমে দেশের মেধাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র করছে পাচারকারীরা। এই অভিমত অনেকের। এ অবস্থায় অভিভাবকগণ উদ্যোগী হয়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা কেন্দ্রের সঠিকভাবে কাউন্সিলিং করে বা চিকিৎসা দেওয়া জরুরী-অভিমত সচেতন মহলের।
লিংকরোড ইলিয়াছ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন বলেন, স্কুল-কলেজগামী কিশোর ও তরুণদের ইয়াবায় আসক্ত হওয়া দেশের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। এই আসক্তি থেকে নিবৃত করার জন্য এসেম্বেলি ক্লাসে প্রতিদিন কাউন্সিলিং করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। তাও মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের নির্দেশনামতে। এভাবে কক্সবাজার শহরের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্টানে শিক্ষার্থীদের মাদকের উপর কাউন্সিলিং খুবই জরুরী বলে তিনি অভিমত দেন। তাহলেই তাদের এই নেশা থেকে আস্তে আস্তে ফেরানো সম্ভব হবে। তরুণ-তরুণীরা ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে কেন?প্রশ্নের জাবাবে ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর বলেন, সাময়িক আনন্দ লাভের জন্যই স্কুল পড়োয়া ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে। ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব বুঝার আগেই এর নেশায় জড়িয়ে পড়ে। ইয়াবা সেবনে যেসব ক্ষতি হয়-ইয়াবা সেবনের ফলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যা একজন মানুষকে মৃত্যুর দিকেই ধাবিত করে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডাক্টার আব্দুচ ছালাম বলেন, নিয়মিত ইয়াবা সেবন করলে ফুসফুস, লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।এদিকে কক্সবাজার শহরে শিশু কিশোর ও তরুণদের মাঝে ইয়াবার বিস্তার আগামীতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে মনে করে সচেতন মহল। বর্তমানে কক্সবাজারসহ সারা দেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে ইয়াবা। ১৯৯৮ সাল থেকে এ দেশে ইয়াবা আসা শুরু হয়। শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করেই ইয়াবা তৈরি করছে মায়ানমার। আবার ভারত থেকেও সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে অবাধে। তাই সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। তবে ইয়াবাকে বন্ধ করার জন্য সরকারও নানা ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। নিয়মিত চালাচ্ছে অভিযান। তাদের কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াবারোধে।
এ ব্যাপারে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সোমেন মন্ডল বলেন, ইয়াবার মতো ভয়াবহ নেশা থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করতে আমরা দিন রাত চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। প্রতিটি জায়গায় অভিযান চলছে, অনেককে গ্রেফতারও করেছি। ইতোমধ্যে জেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্টানে কমিটি করেছি এবং ক্লাসে মাদকের বিরোদ্ধে এভাবে আমাদের মাদক নির্মূলের সর্বাত্বক চেষ্টা চলছে।কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবি এম মাসুদ হোসেন বলেন, কক্সবাজারে ইয়াবা নির্মূলে কাজ করছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। খুব স্বল্প সময়ে আরো যুগোপযুগী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-