ডেস্ক রিপোর্ট – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ‘দূত’ পদ থেকে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে গত ৭ জানুয়ারি থেকে তার নিয়োগ অবসান করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে মন্ত্রীর সমমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৮৮ আসন পেয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৫৭টি, জাতীয় পার্টি ২২টি, ওয়ার্কাস পার্টি ২টি, জাসদ ৩টি, বিকল্পধারা ২টি, তরিকত ফেডারেশন ১টি, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ১টি আসন পেয়েছে। সখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করেছে। ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচন করতে চাইলেও মহাজোটের সঙ্গেই ভোটে যায় জাতীয় পার্টি। অনেক জায়গায়ই ‘নৌকা’ প্রতীকে লড়েছেন দলটির প্রার্থীরা। নির্বাচনের পর দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘোষণা দেন, তারা মন্ত্রিসভায় যাবেন না, বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবেন।
৯ জানুয়ারি সংসদ সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাফর আহমেদ খান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জাতীয় সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত সংসদীয় দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে (রংপুর-৩) জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী বিরোধী দলের নেতা ও লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে স্পিকার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এর ফলে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের পর এবারই প্রথম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে কোনো নারীকে দেখা যাবে না। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিদায়ী দশম সংসদ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা, বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, ‘বিরোধী দল সহিংসতা নয়, দেশ ও জনগণের কথা বলতেই সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হতে চায় জাতীয় পার্টি (জাপা)।’ তিনি বলেন, ‘সংসদ পরিচালনায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে সে কথা বিবেচনা করেই জাপা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা রাখবে।’
জিএম কাদের বলেন, ‘মন্ত্রী পরিষদে জাতীয় পার্টির কোনো সদস্য থাকবে না। দেশের স্বার্থে যেকোনো সংস্কার ও সংশোধনে জাতীয় পার্টি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জাতীয় পার্টির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিরাজমান থাকায় দলটির বড় একটি অংশ সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে সরকারে থাকতে চাইছে। আরেক অংশ স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার পক্ষে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অথবা সংসদের বাইরের দল বিএনপির সঙ্গে দফরফা করে চলার পক্ষেও আছেন অনেক নেতা।
একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে চারজনকে মনোনয়ন দিয়েছে জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বুধবার ওই মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করেন। সংরক্ষিত নারী আসনে জাতীয় পার্টির মনোনীত চারজন হলেন পারভীন ওসমান (নারায়ণগঞ্জ), শাহীনা আক্তার (কুড়িগ্রাম), নাজমা আখতার (ফেনী), মনিকা আলম (ঝিনাইদহ)। গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইতোমধ্যেই মনোনয়নসংক্রান্ত চিঠি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকার বরাবর পাঠানো হয়েছে।
সংসদে জাতীয় পার্টির বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা এবারই প্রথম নয়। দশম সংসদেও দলটি বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরশাদ প্রথমে অংশ নেওয়ার পক্ষে থাকলেও শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। কিন্তু রওশনপন্থীরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে থাকেন ও অংশ নেন। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির তিনজন নেতাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয় এবং নির্বাচন বর্জন করা এরশাদ হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। রওশন হন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা।
ওই সময়ে একাধিকবার জাতীয় পার্টির এমপিদের মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগের কথা জানান এরশাদ। কিন্তু দলের চেয়ারম্যানের কথা শোনেননি কেউ। জাতীয় পার্টির কেউ মন্ত্রিসভা ছাড়েননি। বরং পুরো পাঁচ বছর মন্ত্রিত্ব করে গেছেন।
দশম সংসদের এক অধিবেশনে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আমাদের মন্ত্রীদের উইথড্র করে নেন। আমাদের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে দিন। কিন্তু আমি জানি না, কেন সেটা হয়নি। আর যদি সেটা না-ই হয়, তাহলে আমাদের ৪০ জনকে আপনাদের সরকারে নিয়ে নেন। তাহলে সংসদে বিরোধী দল দরকার নেই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে সাবেক বিরোধীদলীয় এই নেত্রী বলেন, ‘এটা যদি আপনি করতেন, জাতীয় পার্টি বেঁচে যেত। জাতীয় পার্টি সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারত। আমরা এখন সম্মানের সঙ্গে নেই। আমরা যখন বাইরে যাই তখন সবাই বলে, তুমি কোথায় আছ, সরকারে না বিরোধী দলে? আমরা তো বলতে পারি না।’
এ নিয়ে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ মানুষ ও জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়, দলটি আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করছে? অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা, নেতৃত্বের উদাসীনতা ও শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ‘বোঝাপড়া’ না থাকায় দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে দলটি। এ ছাড়াও বিভিন্ন ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে সাধারণ মানুষের আস্থাতেও ভাটা পড়েছে।
ওই সময়ে জাতীয় পার্টির সদস্যদের অনেকেই নিজেদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসেবে আখ্যা দিলেও তা উত্তরণে কোনো উদ্যোগ নেয়নি দলটি। জাতীয় সংসদও একটা কার্যকর বিরোধী দল থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-