ডেস্ক রিপোর্ট – এবার যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর বিচারের উদ্যোগ নিচ্ছে নতুন সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, আর বিলম্ব নয়, জামায়াতকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এ লক্ষ্যে আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধাপরাধ করার দায়ে এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাজা কার্যকর হয়েছে। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান। এই বিচারকালেই একাধিক বিচারক জামায়াতে ইসলামীকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু কোনো নির্বাহী আদেশে সরকার এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেনি। আইনের আলোকে বিচারের মাধ্যমে সরকার এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করতে চায় বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
টানা দ্বিতীয়বার আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর গতকাল মঙ্গলবার আনিসুল হক সমকালকে জানিয়েছেন, ‘দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে দ্রুত আইন সংশোধন করা হবে। বিভিন্ন কারণে আমরা জামায়াতের বিচার এতদিন করতে পারিনি। এবার অবশ্যই করা হবে। জামায়াতের বিচার করতে যেটুকু আইনি সংশোধনের প্রয়োজন, সেটা নিশ্চয়ই করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে শুধু বাংলাদেশের আদালতে নয়, বিদেশি আদালতেও এই সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
জামায়াতের বিচারের লক্ষ্যে কবে নাগাদ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো সময় বেঁধে দেওয়া যাবে না। তবে যথাসম্ভব তাড়াতাড়িই করা হবে।’
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। তারাও মনে করেন আর বিলম্ব না করে দ্রুত বিচার হওয়া উচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর দল হিসেবেও জামায়াতের বিচার করা প্রয়োজন। সে জন্য দরকার সরকারের সদিচ্ছা। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে অধীর অপেক্ষা করছেন। তারা মনে করেন, জামায়াতের বিচার না হলে ত্রিশ লাখ শহীদ পরিবার ন্যায়বিচার পাবে না।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও বিতর্কিত এ দলটি প্রকাশ্যেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বমহল জামায়াতের বিচার নিয়ে সোচ্চার থাকলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। নির্বাচন কমিশনে এ দলটির নিবন্ধন না থাকলেও সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ২৫ জন প্রার্থী বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। তবে তাদের মধ্যে কেউ জিততে পারেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ইতিবাচক। এটা ভালো উদ্যোগ। তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আশা করব, অতি সত্বর আইনটি পাস করে দল হিসেবে জামায়াতকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে প্রচলিত আইনে জামায়াতের বিচার করতে কোনো বাধা নেই বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সমকালকে বলেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। অবশ্যই এটা ভালো উদ্যোগ। আইসিটি অ্যাক্ট সংশোধন করে জামায়াতের বিচার করা যেতে পারে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক সমকালকে বলেন, নতুন প্রজন্মের দাবি জামায়াতকে সব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা। জামায়াতের বিচার করার উদ্যোগ ভালো। আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন বলে মনে করেন তিনি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, ২৭ বছর ধরে আমরা জামায়াতের বিচারের দাবি করে আসছি। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়েছে, এখন সন্ত্রাসী দল জামায়াতের বিচার করতে হবে। দেশ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্র্মূল করতে হলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এতকাল ধরে কেন তাদের বিচার হচ্ছে না, তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, এখনই উপযুক্ত সময়। যত দ্রুত সম্ভব আইন সংশোধন করে জামায়াতের পাশাপাশি আলবদর, আলশামসসহ সংশ্নিষ্টদের বিচারের মুখোমুখি করা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ সমকালকে বলেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জন্য সাধুবাদ। এই সরকারের ওপর জাতির অগাধ আস্থা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের যে উদ্যোগ ও সহযোগিতা পেয়েছি, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখ করার মতো। সরকার আইনি জটিলতা দূর করে জামায়াতকে বিচারের মুখোমুখি করবে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট এক রায়ে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) অবৈধ ও কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করেন। উচ্চ আদালতের এ রায়ের পর নির্বাচন কমিশন যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দলটির নিবন্ধন বাতিল ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে। হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত সর্বোচ্চ আদালতে আপিল দাখিল করলেও গত ছয় বছর ধরে সেই আপিলের শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এরপর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলেও সদ্যসমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ দলটি তাদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। তবে জামায়াতের ২৫ জন প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
রাজাকারের শিরোমণি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের আমির গোলাম আযমের মামলার রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। এরপর বিভিন্ন মহল থেকে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি জোরালো হয়। এরপর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। জামায়াতের বিচার করতে সরকারের পক্ষ থেকে আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হলেও গত ৫ বছরেও তা চূড়ান্ত করা হয়নি।
১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের বিষয়টি দ্রুত সুরাহার দাবি জানায়। তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাননান খান বলেন, ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় দাখিল করা হয়। এরপর প্রায় ৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে; কিন্তু বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যে কোনো উপায়ে জামায়াতের বিচার দ্রুত হওয়া উচিত, যা দীর্ঘদিন ধরে ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে ব্যক্তির বিচারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে সংগঠনের নেই। সেখানে অর্গানাইজেশন বা সংগঠন শব্দটি সংযোজন করলে বিদ্যমান আইনের মাধ্যমেই অভিযুক্ত ব্যক্তির পাশাপাশি কোনো সংগঠন বা দলেরও বিচার করা সম্ভব হবে। পাকিস্তানে দু’বার এবং ভারতে চারবার সাময়িক নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর জামায়াত আবার রাজনীতির সুযোগ পায়। ১৯৮৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৭৯ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হয়েছে। কিন্তু দল হিসেবে জামায়াতের বিচার এখনও হয়নি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-