ডেস্ক রিপোর্ট – দেশে যখন মাদক অভিযানে ধরপাকড় শুরু হয়েছে, তখন মাদকের বড় চোরাচালানকারীরা রুট পরিবর্তন করে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আগে মিয়ানমার থেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফ দিয়ে সরাসরি ইয়াবা ঢুকতো বাংলাদেশে। এখন সেই রুট বদলে মিয়ানমার থেকে মণিপুর-মিজোরাম হয়ে সড়ক পথে কলকাতায় চলে আসছে লাখ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট। সেখান থেকে উত্তর ২৪ পরগনার ঘোজাডাঙা, পেট্রাপোল, ঝাউডাঙা এবং নদিয়া জেলার একাধিক সীমান্তবর্তী গ্রাম দিয়ে নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট বাংলাদেশে ঢুকছে। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশের বরাদ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ৫০ লাখই ইয়াবা আসক্ত। ২০১৭ সালে দেশে আমদানি করা হয়েছিল প্রায় ৩০ কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট। যার পুরোটাই মিয়ানমার থেকে আমদানি হতো। কিন্তু সেই পাচারের রুটটাই এখন বদলে গিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েকমাসে বদলে গিয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে চোরাচালানের সমীকরণ। গরু ছেড়ে এখন সীমান্তের বড় চোরাচালানকারীরা ঝুঁকছেন ইয়াবা পাচারের দিকে। সীমান্ত এলাকার ব্যবসায়ীদের দাবি, গত মে মাস থেকে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে চলা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানই ভাগ্য বদলে দিয়েছে এখানকার কারবারিদের।
বসিরহাটের কাছে ঘোজাডাঙা সীমান্তের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে যারা মূলত গরু এবং অস্ত্র পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারাই এখন ইয়াবা পাচার করছে। কারণ গরু বা অস্ত্র পাচারের থেকে ইয়াবায় ঝামেলা কম এবং টাকাও বেশি।সূত্র জানায়, পাচারকারীরা প্রতি হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করে আয় করে সাত থেকে আট হাজার টাকা। ধরপাকড়ের আগে বাংলাদেশে এক একটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম ছিল ৩০০ টাকা। এখন সেটাই বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। নিরাপদে ইয়াবা মজুদ করছেন অনেক বড় ব্যবসায়ীরাও। এক লাখ ট্যাবলেট এক সপ্তাহ রেখে দিলে মিলছে তিন লাখ। আর বেশি মুনাফার লোভে দলে দলে যোগ দিচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়। কলকাতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে মাদক পাচারের নতুন করিডর।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, প্রথম কয়েক মাস টানা পুলিশি অভিযানে ব্যবসায় কিছুটা মন্দা দেখা দিলেও চোরাকারবারিরা দ্রুত বিকল্প রুট এবং পাচারকারীদের নয়া নেটওয়ার্ক তৈরি করে নেয়। দু’দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প এলাকার ইস্তিয়াক আহমেদ বা করাইল বস্তির বাবা কাসেমের মতো কুখ্যাত মাদক কারবারিরা কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক। তাদের মতো বড় মাদক কারবারিরা শুরুতেই গা-ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ পালিয়ে ভারতে লুকিয়ে আছে। ধরা পড়েছে মূলত ছোট পাচারকারীরা। ফেরার মাদক মাফিয়ারা তাই দ্রুত নতুন রুট তৈরি করে নেয়।
গোয়েন্দাদের দাবি, আগে মিয়ানমার থেকে সরাসরি নাফ নদি পেরিয়ে টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকত ইয়াবা। কিন্তু ধরপাকড়ের পর প্রথমে দু’টি বিকল্প রুট তৈরি হয়। এ নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সেই তথ্য অনুসারে, বিকল্প রুটের প্রথমটি ছিল মিয়ানমার থেকে মিজোরাম হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ। অন্যটি ছিল বাংলাদেশের পটুয়াখালি, কুয়াকাটা হয়ে নদীপথে ঢাকা। কিন্তু র্যাব কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেই রুটের হদিস পাওয়ায় এবার পুরো রুটটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে পাচারকারীরা।
নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র গোয়েন্দাদের দাবি, এখন মিয়ানমার থেকে মনিপুর-মিজোরাম হয়ে সড়ক পথে কলকাতায় চলে আসছে লাখে লাখে ইয়াবা ট্যাবলেট। তারপর কলকাতা এবং সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় জমা করে রাখা হয় সেই মাদক। প্রথম দিকে বাংলাদেশ থেকে মাদক বহনকারীরা এসে নিয়ে যেত ট্যাবলেট। এ রকমই একটি গ্যাং-কে সমপ্রতি কলকাতার বেনিয়াপুকুর থেকে আটক করে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, এখন উত্তর ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার গরু পাচারের করিডর ধরেই প্রতিদিন পাচার হচ্ছে লাখ লাখ টাকার ইয়াবা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের মে মাসে দেশ জুড়ে মাদক বিরোধী কঠোর অভিযানের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, টানা অভিযানে প্রায় ২৫ হাজার দাগী এবং সন্দেহভাজন মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গিয়েছে কয়েক জন কুখ্যাত মাদক কারবারি। যদিও ঢাকার একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা দু’শর বেশি। গত আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশের এই মাদক বিরোধী অভিযানে একের পর এক সন্দেহভাজন মাদক কারবারির মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এরপর অভিযানে কিছুটা ভাটা পড়লেও তত দিনে বদলে গিয়েছে বাংলাদেশে ইয়াবা আমদানির সমস্ত রুট।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) ড. এ এফ এম মাসুম রাব্বানী ইত্তেফাককে বলেন, মাদক প্রতিরোধে যেহেতু টেকনাফে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে, সেহেতু মাদক চোরাচালানকারীরা রুট পরিবর্তন করতে পারে। এখন নিরাপদ রুট হিসেবে বিমানপথে ইয়াবা পাচার হচ্ছে এবং চালানও ধরা পড়ছে। মিয়ানমার থেকে কলকাতা হয়ে দেশে ইয়াবা আসার বিষয়ে দুই দেশের মাদকসহ চোলাচালান নিয়ন্ত্রণে আমরা সমন্বয়ে কাজ করছি। সমপ্রতিকালে মেঘালয়ের একটি রুট দিয়ে ৪ কোটি ইয়াবাসহ একটি চালান ভারতে আটক করা হয়েছে। পাচারকারীদের রুট পরিবর্তন বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-